অগ্নিঝরা মার্চ ও ইমাম সাহেব

তোফায়েল আহমাদ মামুন: অস্ত্র হাতে ইমাম সাহেবকে এদিকে আসতে দেখে সবাই ভয় পেয়ে যায়। অন্য সময় যারা আগ বাড়িয়ে ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলতো, আজ তারা সালামও দিচ্ছে না। ইমাম সাহেবের সাথে এলাকায় রফিক মাদবরের সম্পর্কটা একটু বেশি। তিনিও আজ সালাম ছাড়া অন্য কথা বলতে সাহস করেননি। ইমাম সাহেব শুধু সালামের উত্তর দিয়ে অস্ত্র হাতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিন হলে রফিক মাদবর সালামের পর আগ-বাড়িয়ে মুসাফাও করতেন। তার ঘরের বারান্দা না মাড়িয়ে ইমাম সাহেবকে যেতে দিতেন না।

ইমাম সাহেব খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ সবার সাথে হাঁসি মুখে কথা বলেন। কড়া ভাষায় কথা বলা যেন, তিনি জানেনই না। কোমল ও মিষ্টিভাষী হিসেবেই সবাই তাকে চিনে। আজ পাঁচ বছর হলো, এখানে ইমামতি করছেন। কোনো দিন কারো সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয় নি। সবার কাছেই তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ও প্রিয় মানুষ। কখনো কারো সাথে মনোমালিন্য হয়েছে বলেও এলাকায় কেউ বলতে পারবে না। আজ তাহলে ইমাম সাহেবের কী হলো? অস্ত্র কেন হাতে? আর যাচ্ছেন-ই বা কোথায় ? অস্ত্র হাতে যারা ইমাম সাহেবকে দেখেছে –সবার চোখে- মুখে একই প্রশ্ন।

গণ আন্দোলনে উত্তাল দেশ। সবখানে এ নিয়ে আলোচনা। আস্তে আস্তে দেশের মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। নিজের অধিকার হতে বঞ্চিত থাকতে কেউই আর রাজি নয়। এতদিন সব অন্যায় মেনে নিলেও আজ তারা মুক্তি চায়। দীর্ঘকাল স্বঅধিকার ভুলে থাকলেও আজ অধিকার ফিরে চায়। 

মসজিদের পাশে, বটতলার আড্ডাটা খুব জমে ইদানিং। কাম-কাজের ফাঁকে একটু সুযোগ পেলেই এখানে এসে উঁকি দেয় এলাকার লোকজন। কেউ আসে নতুন সংবাদ জানতে । দেশের কোথায় কী হচ্ছে। আবার কেউ আসে নতুন খবর নিয়ে। অমুকে বলেছে ঢাকায় মিছিল হয়েছে। অমুক জায়গায় মিছিলে বাধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইমাম সাহেব কোন দিনই সে বটতলায় আসেননি । এ বিষয়ে কোনো কথাও বলেননি, তিনি একেবারে নীরব। তবে এলাকার গণ্যমান্য লোকেরা মাঝে-মধ্যে ইমাম সাহেবের কামরায় গিয়ে দেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেন।

৭’ই মার্চের পর কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। ইমাম সাহেব যেন, এ বিষয়ে কিছু জানেনই না। এমন ভাবে থাকেন। এ নিয়ে এলাকাবাসি কিছু মনে করে নি। তিনি সহজ-সরল আল্লাহ ওয়ালা মানুষ। মসজিদ আর মক্তব নিয়েই ব্যস্ত। 

২৬ মার্চের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে তাদের হয়ে অনেকেই কাজ করছে। আজ-কাল ইমাম সাহেবকেই সন্দেহ করছে লোকজন। তিনি হয় তো পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে কাজ করছেন। না হয় তিনি এতো নীরব কেন ? আবার অনেকেই ভাবে ,না। তিনি এটা করতে পারেন না। 

দরজায় ঠকঠক শব্দে ঘুম ভাঙে ইমাম সাহেবের। তিনি বিছানা থেকে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করেন, কে? বাহির থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে একজন বলছে হুজুর একটু পানি খাব, অনেক বেশি তৃষ্ণা পেয়েছে। ইমাম সাহেব দরজা খুলে হারিকেনের আলোতে বাহিরে দেখেন, অস্ত্র হাতে একলোক দাঁড়ানো। তিনি ভয় পেয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ করে, কিছুটা কড়া ভাষায় জিজ্ঞেস করেন। কে আপনি ? কোত্থেকে এসেছেন? 

-লোকটি বলে- হুজুর আমার বাড়ি উত্তর পাড়া। আমার পানির খুব তৃষ্ণা লেগেছে। হুজুর অস্ত্র দিয়ে আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবো না। আমি চোর ডাকাতদের কেউ না। আরো কিছু কথা বলার পর লোকটির প্রতি ইমাম সাহেবের আস্থা আসে। দরজা খোলে হারিকেনের আলোতে ভালো করে দেখেন তাকে। লোকটিকে এ এলাকারই মনে হলো দেখে। তাকে নিজের খাটে বসতে দিলেন। মাটির কলস থেকে নিজ হাতে পানি ঢেলে লোকটাকে খেতে দেন। পাত্রটা হাতে নিয়েই ঢকঢক করে গিলতে থাকে সে। এক নিঃশ্বাসেই পাত্রের পানি শেষ।

 – আরো একটু পানি দিবো?

– না হুজুর। 

লোকটি তখনও হাঁপাচ্ছে। তার হাঁপানো দেখে ইমাম সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। হারিকেনটা দরজার কাছে রেখে বাহিরে গেলেন। অস্ত্রগুলো নিয়ে কামরায় ডুকে বললেন। আপনি একটু বিশ্রাম নেন। পরে বাকি কথা বলবো।

-না হুজুর, এখনি আমি চলে যাবো। আমার অনেক কাজ। যদি পাকিস্তানি বাহিনী জানতে পারে আমি এখানে, তাহলে আপনি সহ এলাকার সবার ক্ষতি করবে। যদি কিছু মনে না করেন, এখনি বলতে পারেন। বাকি কথা শেষ করেই চলে যাবো। 

ইমাম সাহেব লোকটির সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তাদের যাবতীয় তৎপরতার ব্যপারে জেনে নেন। সে এখন কোত্থেকে এসেছে ? কোথায় যাবে? অস্ত্রগুলো কোথায় পেয়েছে?

ইমাম সাহেব আগে দেশের বিষয়টি উড়োউড়ো ভাবে শুনলেও এখন লোকটির থেকে দেশে যুদ্ধের বিষয়টি ভালোভাবে জেনে নিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি ২৫ শে মার্চের রাতের অন্ধকারে অস্ত্র হাতে ঝাপিয়ে পড়ে ঢাকার জনগণের উপর। নির্বিচারে হত্যা করে শত শত মানুষ। ঘুমন্ত মানুষেরাও বাদ যায়নি। রেহাই পায়নি দুধের শিশুরাও।

বাংলার সন্তানেরাও নেমে আসে প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের যুদ্ধে। নেমে আসে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। আধুনিক সমরাস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দক্ষ সামরিক বাহিনীর বিপরীতে বাংলার সাহসী সন্তানদের হাতে কী আছে? তারা জানে, তাদের কোনো অস্ত্র নেই। তাদের আছে শুধু অফুরন্ত সাহস, প্রচন্ড মনোবল এবং গভীর দেশপ্রেম। আছে প্রাণের শক্তি, আর স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার দৃঢ় সংকল্প।

ইমাম সাহেব লোকটার সাথে আরো কিছু সময় কথা বলেন । শেষে বললেন- আপনি দু’রাত ধরে ঘুমাননি। আজ রাতটা এখানে থেকে যান। আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না। 

-না, হুজুর। রাত শেষ হওয়ার আগেই আমাকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। সকালে এই বড় রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়ীবহর যাবে। পিছনের জঙ্গল থেকে আমরা ক’জন আক্রমণ করবো। গত রাতে আক্রমনে এই অস্ত্রগুলো ছিনিয়ে এনেছি।

 কথায় কথায় রাত প্রায় শেষের দিকে। ফজরের আজানের মাত্র কিছূ সময় বাকী আছে। লোকটি বললো -হুজুর,  এখন আমাকে যেতে হবে। একটা অস্ত্র আপনার কাছ রেখে যাই। আগামী

কাল রাতে এসে নিয়ে যাব। এখন যাই হুজুর। আসসালামুয়ালাইকুম।

 বেরিয়ে গেল লোকটি। এলাকায় এখন থম থমে অবস্থা। মুক্তিবাহিনীর কাউকে যদি, কোনো গ্রামে পাওয়া যায়। তাহলে পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয় নির্বিচারে। ইমাম সাহেব অপেক্ষায় আছেন কখন রাত হবে? লোকটি আসবে?

রাত গভীর হয়েছে। ইমাম সাহেব ঘুমান নি । লোকটির অপেক্ষায় আছেন। এরিমধ্যে দরজায় শব্দ হলো। কে? – হুজুর আমি এসেছি। 

ইমাম সাহেব দরজা খুলে হারিকেনের আলোয় দেখেন, লোকটি আজ আরো দুটি অস্ত্র নিয়ে এসেছে। আজ বেশি কথা বলে নি সে। শুধু একটা অস্ত্র রেখে চলে গেছে।। যাওয়ার আগে বলে গেল। দেশের জন্য যুদ্ধ করবে, এমন কাউকে যদি পাওয়া যায় তাহলে অস্ত্রগুলো দিয়ে দিতে। আগামীকাল রাতে আবার আসবে।

আজ আবার লোকটি এসেছে, শেষ রাতের দিকে। তবে হাতে কোনো অস্ত্র নেই। বা হাতে‌র আঙ্গুল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। কী হয়েছে? আজ রাতেও পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করেছি। কিন্তু পুরোপুরি সফল হইনি। এখনো যুদ্ধ চলছে। আরেকটা অস্ত্র লাগবে । খাটের নিচ থেকে একটি অস্ত্র বের করে কাঁধে নেয় লোকটি…!

ফজরের নামাজের পর ইমাম সাহেব মুসল্লিদের বসতে বলেন । সমবেত মুসল্লিদের সামনে দাঁড়িয়ে, কোন ভূমিকা ছাড়াই বলে ফেললেন –

‘আপনারা নতুন ইমাম খোঁজেন। আমি আর এখানে থাকবো না। এখন থেকে আমিও মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য।’ মুসল্লিরা কিছু বলা অথবা বুঝে উঠার আগেই ইমাম সাহেব মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেন। কামরা থেকে অস্ত্রটা কাঁধে নিয়ে, স্বাধীনতার সবুজ স্বপ্ন বুকে ধারণ করে। বীরদর্পে হাঁটা ধরলেন মসজিদের সামনে দিয়ে। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে।