জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মিরপুরের মুহতামিম। কওমি মাদ্রাসাসমূহের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হাইআতুল উলইয়ার সদস্য ও কওমি শিক্ষা বোর্ড বেফাকের সহসভাপতি। লেখক হিসেবে তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন রমজানের প্রস্তুতি, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিচালনাসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুফতি এনায়েতুল্লাহ
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া
দেশ রূপান্তর : পবিত্র রমজানের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে পারি?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : পবিত্র মাহে রমজান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশেষ নেয়ামত। এ মাসে নেকি লাভের বিশেষ সুযোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। সাহাবায়ে কেরামকে বিশেষ উৎসাহ দিতেন। পূর্ববর্তী আলেমরা রমজানের আগেই পার্থিব কাজকর্ম থেকে মুক্ত হয়ে যেতেন। ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের মশগুল রাখতেন। আমাদেরও পার্থিব কাজ থেকে মুক্ত হয়ে দিনে রোজা, কোরআন তেলাওয়াত, দান-খয়রাত, রাতে তারাবির নামাজ ও কিয়ামুল লাইলে ব্যস্ত থাকা, বেশি বেশি তওবা-ইস্তিগফার করা; কান্নাকাটিতে মশগুল থাকা দরকার। মোটকথা, নিজেকে স্রষ্টার জন্য সম্পূর্ণরূপে নিবেদিত করা। রমজানের ক্ষমা লাভের সুযোগ লাভে কোনো রকম অবহেলা না করা।
দেশ রূপান্তর : বিশেষ কোন আমলকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : দিনের বেলায় বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা। রাতে জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায়ে কোনো ধরনের অবহেলা না করা। খতমে তারাবিকে গুরুত্ব দেওয়া, সঙ্গে সঙ্গে কিয়ামুল লাইল এবং সামর্থ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করা। সব ধরনের পাপাচার থেকে বিরত থাকতে সর্বাধিক সচেষ্ট থাকা।
দেশ রূপান্তর : রমজানে বিভিন্ন মাদ্রাসায় নানা ধরনের কোর্স হয়, এগুলো কী ছাত্রদের কোনো উপকারে আসে?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : শিক্ষার্থীদের উপকারের জন্যই তো কোর্সগুলোর আয়োজন করা হয়। উপকার যে হয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। শাবান মাসের প্রথম দিকে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীদের বাড়িতে থাকতে হয়। পরিবেশ এবং সঙ্গদোষের অনেক সময় তাদের মানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে রমজানে পরিচালিত কোর্সগুলো খুবই কার্যকর। এ ছাড়া যে বিষয়ে দুর্বলতা থাকে, কোর্সে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ফলে তা অনেকটাই কমে আসে। অন্যদিকে পাঠ্যসূচির বাইরে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় কোর্সে যুক্ত থাকে। ফলে অংশগ্রহণকারীদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃতি হয়। তবে আয়োজকদের সদিচ্ছা এবং শিক্ষার্থীদের আগ্রহের ওপর সবকিছু নির্ভর করে।
দেশ রূপান্তর : অভিযোগ রয়েছে, মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের কোনো বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয় না। এর ফলে নতুন শিক্ষকরা কি সফলভাবে কাজ করতে পারছেন?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : এটা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায়, নতুন শিক্ষকরা প্রবীণদের সংশ্রবে থেকে হাতে-কলমে অনেক বিষয়ে শেখেন। ফলে প্রশিক্ষণ না থাকায় কওমি শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন প্রভাব পড়ছে না। শিক্ষার মান এবং গ্রহণযোগ্যতায় ঘাটতি আসছে না। এর পরও বেফাকের পক্ষ থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়, নুরানি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
দেশ রূপান্তর : এবার ২০ হাজারের বেশি ছাত্র দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এই নবীন আলেমদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : নবীন আলেমদের উদ্দেশে আমার কথা হলো গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া যাবে না। বিপরীত স্রোতের সঙ্গে মিশে অর্জিত শিক্ষার আবেদন ভূলুণ্ঠিত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নবীর ওয়ারিশ হিসেবে দ্বীনের সব ময়দানে নিজেদের সরব রাখতে হবে। কিছু প্রথাকেই একমাত্র কাজ মনে করে যারা দ্বীনের অন্যান্য কাজ করছেন তাদের ভিন্ন দৃষ্টিতে না দেখা। পার্থিব মোহে আক্রান্ত হওয়া যাবে না।
দেশ রূপান্তর : একজন আদর্শ মুহতামিমের কী কী গুণ থাকা উচিত বলে মনে করেন?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : আদর্শ মোহতামিমের জন্য আমার মতে তাকওয়া-পরহেজগারী, আমানতদারীর সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব সচেতন থাকা জরুরি। সেই সঙ্গে প্রবল ধৈর্যশক্তির অধিকারী হওয়া।
দেশ রূপান্তর : কওমি মাদ্রাসায় যে সিলেবাস পড়ানো হয়, তা কি যুগোপযোগী?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : সিলেবাস সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে প্রথমে কওমি মাদ্রাসার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কওমি মাদ্রাসা জাতির জন্য কী উপহার দিতে চায় তা জানা প্রয়োজন। এক
কথায়, কওমি মাদ্রাসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী সিলেবাস ঠিক আছে। দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিলেবাসে নানা সময় নানা বিষয় যেমন যুক্ত করা হয়েছে, তেমনি কিছু বিষয় বাদও পড়েছে। সুতরাং সিলেবাস যুগোপযোগী নয়, এটা বলার অবকাশ নেই।
দেশ রূপান্তর : মাদ্রাসার কালেকশনের জন্য ছোট ছাত্রদের রাস্তায় নামানো কতটুকু যৌক্তিক?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : কওমি মাদ্রাসাগুলো সাধারণ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। তাই বলে মাদ্রাসার উন্নয়ন কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে ছোট ছাত্রদের দিয়ে রাস্তায় কালেকশনের জন্য নামানো মোটেও সমীচীন নয়। এমন কাজ থেকে সবার বিরত থাকা অপরিহার্য। অনেকে আবার রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, মসজিদের কথা বলে চাঁদা সংগ্রহ করে, অভিযোগ রয়েছে এর বেশির ভাগই যথাযথ খাতে ব্যয় হয় না। এগুলো নিন্দনীয় কাজ। যারা এমন কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা যেতে পারে।
দেশ রূপান্তর : ধর্মীয় বিষয়ে নানা দল-উপদল প্রায়ই বিভিন্ন অযাচিত বিতর্কে জড়াচ্ছে, এটা কি দ্বীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : কোনো বিষয়েই অযাচিত বিতর্কে জড়ানো উচিত নয়। তবে আকিদা-সংক্রান্ত হলে তার সঠিক জ্ঞান জাতির সামনে তুলে ধরা অপরিহার্য।
দেশ রূপান্তর : ছাত্রদের মধ্যে শর্টকোর্সমুখী হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এটা কী ভালো কিছুর লক্ষণ?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : দেখুন, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় শর্টকোর্স শুরু করা হয়েছিল মূলত ইংরেজি শিক্ষিত ও হাফেজদের জন্য। তারা যেন ৫-৬ বছর মেহনত করে নিজে কোরআন-সুন্নাহ বোঝার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে এতে আপত্তির কিছু ছিল না। কিন্তু এখন অল্প বয়সী অনেক ছেলেও কম সময়ে আলেম হওয়ার জন্য এই নেসাবে পড়াশোনা করছে। অথচ তাদের দেওবন্দি নেসাব অনুযায়ী পড়াশোনা করতে কোনো অসুবিধা ছিল না।
দেওবন্দি নেসাবের মাদ্রাসায় ছাত্রদের বহুমুখী যোগ্যতা অর্জনের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে দাওয়াত, তালিম, তাজকিয়াসহ যেকোনো বিষয়ে তারা খেদমতের যোগ্যতা রাখে। কিন্তু শর্টকোর্সের মাধ্যমে বহুমুখী যোগ্যতা অর্জন না হওয়ায় তারা দ্বীনের যথাযথ খেদমত করতে পারছে না। অনেকে পরিণাম না বুঝে কম সময়ে আলেম হওয়ার জন্য ওইসব মাদ্রাসার দিকে ঝুঁকছে, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
দেশ রূপান্তর : রমজান মাসে বিভিন্ন টেলিভিশনে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়, অনেক মাদ্রাসা কর্র্তৃপক্ষ এই প্রতিযোগিতার জন্য প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করেন, এটাকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া : রমজান মাসে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে হিফজুল কোরআনসহ ইসলামি নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিভা অন্বেষণের নামে এমন আয়োজন নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। প্রাইভেট মাদ্রাসাগুলো বাদে সাধারণ কওমি মাদ্রাসাগুলোর অংশগ্রহণ সেখানে খুব একটা নেই বললেই চলে। এর দ্বারাই বোঝা যায়, এসব রিয়্যালিটি শোতে বিজয়ী হওয়া, পুরস্কার পাওয়া হেফজ শিক্ষার মানদণ্ড নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কোনো মাদ্রাসা কর্র্তৃপক্ষের জন্য উচিত হবে না, এ তো মাত্র প্রতিযোগিতায় টিকা, পুরস্কার পাওয়াকে লক্ষ্য বানানো। আর ওইসব প্রতিযোগিতায় অংশ না নিলে, বিজয়ী না হলে, সেরা দশে স্থান না পেলে সেগুলো সেরা মাদ্রাসা বলে বিবেচিত হবে না এমন নয়।
সূত্র: দৈনিক দেশ রূপান্তর