আজ ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩০ বছর

পয়গাম ডেস্ক :

আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২,২২:৩৫

ভারতের উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের রামকোট পর্বতের ওপর অবস্থিত পাঁচ-শতাব্দী-প্রাচীন বাবরি মসজিদ। মোঘল সম্রাট বাবরের আদেশে সেনাপতি মীর বাকি ১৫২৮-২৯ (৯৩৫ হিজরি) খৃস্টাব্দে এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি সুলতানি স্থাপত্যের পরিচয় বহন করে।

হিন্দুদের দাবি—অযোধ্যার যে স্থানে বাবরি মসজিদ নির্মিত, সে স্থানটি রামের জন্মভূমি। মোঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি একটি রাম মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। তবে এর স্বপক্ষে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তবুও কেবল বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে ১৮২২ সালে ফৈজাবাদ আদালতের এক কর্মী দাবি করেন, মসজিদটি মন্দিরের ওপর নির্মিত। ১৮৫৫ সালে মসজিদের জমি দখল নিয়ে হৈচৈ হয়। ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন সংঘর্ষ এড়াতে মসজিদের ভূখণ্ডে হিন্দু-মুসলিমের জায়গা দেয়াল তুলে আলাদা করে দেন।

এরপর ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। কিন্তু ১৯৪৯ সালে হিন্দু মহাসভার সদস্যরা মসজিদের ভেতরে গোপনে রাম মূর্তি স্থাপন করে। এ নিয়ে মুসলিম এবং হিন্দুদের মাঝে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আইনের দারস্থ হলে আদালত মসজিদের জায়গাটিকে বিতর্কিত স্থান ঘোষণা দিয়ে সিলগালা করে দেয়। তখন মুসলিম হিন্দু উভয়েই ওই স্থানে প্রবেশাধিকার পেতে আদালতকে মামলা করে। ১৯৫৯ সালে মামলা করে নির্মোহী আখড়া। ১৯৬১ সালে মামলা করে সুন্নী সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড। এরপর আদালত ১৯৮৬ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি ওই স্থানে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের প্রবেশাধিকার দিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়। সরকারে তখন রাজীব গান্ধী। গান্ধী হিন্দুদের প্রবেশাধিকার দিয়ে মসজিদের তালা খুলে দেয়।

বাবরি মসজিদের শাহাদাত

১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজেপি নেতা এল. কে. আদভানি রাম রথযাত্রা নামের একটি রাজনৈতিক শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। শোভাযাত্রাটি গোটা উত্তর ভারত ঘুরে অযোধ্যাতে এসেছিল। এই শোভাযাত্রা বাবরি মসজিদের জায়গায় প্রস্তাবিত মন্দিরের জন্য সমর্থন আনার জন্য এবং মুসলিমবিরোধী মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু ভোটগুলোকে একটি দলের বাক্সে আনার পক্ষে কাজ করেছিল।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো ঐ বিতর্কিত স্থানে আরেক শোভাযাত্রার আয়োজন করে। শোভাযাত্রায় শামিল হয়েছিল দেড় লাখ ভিএইচপি এবং বিজেপি কর সেবক। এছাড়া, অনুষ্ঠানে আদভানি, মুরলি মনোহর জোশি ও উমা ভারতীর মত বিজেপি নেতা ভাষণ দিয়েছিলেন। শোভাযাত্রা চলাকালীন সময়ের প্রথম দিকে জনতা ক্লান্তিহীনভাবে স্লোগান দিচ্ছিল। সহিংসতা প্রতিরোধে স্থাপনাটির চারদিকে পুলিশি বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল। দুপুরের দিকে এক যুবক বেষ্টনী অতিক্রম করে স্থাপনাটির উপরে চলে যায় এবং গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করে। এই ঘটনা ছিল সহিংসতার আগমনবার্তা। এরপর, উন্মত্ত জনতার সামনে পুলিশি বেষ্টনী বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। এরপর, উন্মত্ত জনতা কুঠার, হাতুড়ি এবং গাইতি দিয়ে ইমারতটি ভাঙা শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার মাঝে কাদা ও চুনাপাথর দ্বারা নির্মিত ইমারতটি মাটির সাথে মিশে যায়। শহীদ হয় পাঁচ-শতাব্দী-প্রাচীন বাবরি মসজিদ। যার ফলে পুরো ভারত জুড়েই দাঙা ছড়িয়ে পরে। এর জেরে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যায়। যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম।

বাবরি মসজিদ মামলার রায়

২০০২ সালে বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জমির মালিকানা নিয়ে হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয়—বিতর্কিত জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামলালার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হোক। এর ফলে এর ফলে হিন্দুরা পায় জমির তিন ভাগের দুই ভাগ। মুসলিমরা এক ভাগ।

এর বিরুদ্ধে সব পক্ষই উচ্চ আদালতে আপীল করে। ৯ নভেম্বর, শনিবার, ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের রায়কে রদ করে ঘোষণা দেয় ২.৭৭ একরের পুরো জমিই এমন একটি ট্রাস্টকে দিতে হবে, যারা হিন্দু মন্দির নির্মাণ করবে। একই সাথে আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয় সুন্নী ওয়াকফ বোর্ডকে বিকল্প ৫ একর জমি দিতে হবে মসজির নির্মাণের জন্য এবং সে জমি অযোধ্যায়ই হতে হবে।

এ রায় ঘোষণা করেন ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ। পাঁচ সদস্য হলেন-প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবদে, বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি অশোক ভূষণ এবং বিচারপতি আবদুল নাজির।

১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে কেন্দ্রীয় সরকার মসজিদ ধ্বংসের বিষয়টি তদন্ত করার জন্য অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ আদালত বিচারক মনমোহন সিং লিবারহানের নেতৃত্বে লিবারহান কমিশন গঠন করে। ১৬ বছরে ৩৯৯ বার বৈঠকের পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন কমিশন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১,০২৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা ‘অপ্ররোচিত কিংবা অপরিকল্পিত’ ছিল না।

প্রতিবেদনে ৬৮ জন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিজেপি নেতা। দোষী ব্যক্তিদের নামের তালিকায় বাজপেয়ী, আদভানি, জোশি এবং বিজয় রাজে স্কিন্দিয়ার নাম ছিল। উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের সমালোচনা করা হয় প্রতিবেদনটিতে। প্রতিবেদনটিতে সে সময়ে ইমারতটি ভাঙার সময় অযোধ্যার পুলিশ ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কথা উল্লেখ করে হয়েছে। আদভানির নিরাপত্তার অঞ্জু গুপ্তা বলেছেন যে, আদভানি ও জোশির বক্তব্য জনতাকে আরো উন্মত্ত করে তুলেছিল সেদিন। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে যে ,নেতাদের কাজ তাদের মনের গহীনে বিতর্কিত ইমারতটি ভাঙার সুপ্ত ইচ্ছাকেই ফুটিয়ে তোলে। নয়ত তারা খুব সহজেই ধ্বংসযজ্ঞটি থামাতে পারত।

২০০৫ সালের মার্ভে একটি বইয়ে সাবেক গোয়েন্দা প্রধান মলয় কৃষ্ণ ধর দাবি করেন যে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), বিজেপি এবং ভিএইচপির নেতারা ইমারতটি ভাঙার দশ মাস পূর্বেই এটি ভাঙার পরিকল্পনা করেছিলেন। বইটিতে ইস্যুটির ব্যাপারে পি. ভি. নরসিমা রাওয়ের পদক্ষেপের সমালোচনা করা হয়। ধর আরো দাবি করেন, তিনি বিজেপি ও সংঘ পরিবারের ব্যক্তিদের একটি বৈঠকের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্বে ছিলেন এবং বৈঠকটিতে নিঃসন্দেহে তারা (আরএসএস, বিজেপি, ভিএইচপি ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় হিন্দুত্বের জিগির তুলে প্রলয় সৃষ্টির নীল নকশা রচনা করেছিলেন। আরএসএস, বিজেপি, ভিএইচপি এবং বৈঠকে উপস্থিত বজরং দলের নেতাদের সবাই সুসংগঠিতভাবে কাজটি সম্পন্ন করতে চাইলেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, তিনি ঐ বৈঠকের কথাবার্তা রেকর্ড করে তার উপরের কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। ব্যাপারটা তার উপরের কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রী (রাও) এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে (শঙ্কররাও চবন) অবহিত করেছিলেন। তিনি আরো দাবি করেন, এ বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে স্বীকার করুক আর নাই করুক, মনে মনে সবাই স্বীকার করে যে, অযোধ্যার ঘটনা হিন্দুত্বকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনন্য সুযোগ হিসেবে কাজ করেছে।

বাবরি মসজিদের জমির রায় হয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বের ১৯৯২ সাল থেকে ২৮ বছর ধরে চলা এই মামলার একপেশে রায় প্রদান করেছে ভারতের বিশেষ আদালত। সেই রায়ে অভিযুক্ত সবাইকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করা হয়েছে। লখনউয়ের বিশেষ আদালতে রায় পড়েন বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদব। বিচারকের যুক্তি ‘ওই কর্মকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত ছিল না’। তথ্যপ্রমাণও যথেষ্ট নয় বলে জানায় আদালত। অভিযুক্ত ৩২ জনকেই সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয়।