আত্মপ্রচারের যুগে নীরবে আলো বিলানো ব্যক্তিত্ব

মুফতি তাজুল ইসলাম। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদের শায়খুল হাদিস ও প্রধান মুফতি। তিন দশকের বেশি সময় ধরে হাদিসের প্রধান কিতাব সহিহ বোখারি শরিফ পড়াচ্ছেন। প্রচারবিমুখ এই আলেমের হাজার হাজার ছাত্র ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশ জুড়ে। নিজেকে প্রকাশ ও প্রচারের আলোয় না আনার যে চর্চা ও রীতি পূর্ববর্তী আলেমদের ছিল, তার বাস্তব নমুনা তিনি। লিখেছেন মুফতি এনায়েতুল্লাহ

বাহ্যিক সৌন্দর্য মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তবে ব্যক্তিত্ব মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মানুষ ব্যক্তিত্বের কারণে হয় স্মরণীয় ও সম্মানীয়। আবার ব্যক্তিত্বহীনতার কারণেই হয় নিন্দনীয়। ব্যক্তিত্ব মানবসম্পদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্পদ, যার মাঝে এই সম্পদ আছেতার অন্য কোনো সম্পদ না হলেও চলে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ আত্মপ্রচার বিমুখ এবং নিজ কাজে বিশ্বাসী হয়। তাদের দ্বারা সমাজ হয় আলোকিত ও মানুষ হয় উপকৃত। এমন একজন আলোকিত ব্যক্তিত্ব হলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও শায়খুল হাদিস মুফতি তাজুল ইসলাম।

ইসলামে আকিদার (বিশ্বাস) গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু যুগে যুগে বিভিন্ন ভ্রষ্ট চিন্তা ইসলামের এই বিশ্বাসে আঘাত হেনেছে। ভ্রান্ত নানা মতবাদে জড়িয়ে অনেক সহজ-সরল মুসলমান বিভ্রান্ত হয়েছেন। ধর্মের ছদ্মাবরণে আবর্তিত এসব ফেতনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই এগুলোর ভয়াবহতা উপলব্ধি করেন, কিন্তু এর প্রতিরোধ ও সংশোধনের চেষ্টা করেন না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মুফতি তাজুল ইসলাম।

খ্যাতিমান এই আলেম বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে বিস্তৃত ও গভীর পড়াশোনা করে এ বিষয়ে জাতিকে সতর্ক করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি পুস্তক রচনা করেছেন। সেই সঙ্গে ক্লাসে ছাত্রদের এবং ওয়াজ মাহফিলে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করার কাজ অব্যাহত রেখেছেন।

মুফতি তাজুল ইসলাম হাদিস অস্বীকারের ফেতনার মোকাবিলায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর মর্যাদা হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন, শিয়া মতবাদ খণ্ডনের লক্ষ্যে সাহাবিদের ফজিলত ও মর্যাদা বর্ণনা, কাদিয়ানি মতবাদের মোকাবিলায় খতমে নবুয়তের প্রমাণ ও এর দাবিসমূহ মানুষকে বোঝানো, মাজহাব অস্বীকারকারীদের মোকাবিলায় মাজহাবের ইমামদের মর্যাদা ও উম্মতের প্রতি তাদের অবদানসমূহ এমন হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করেন; যার বর্ণনা দেওয়া মুশকিল। ভ্রান্ত মতবাদ ও বিশ্বাসের অসারতা প্রমাণে তার যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় মানুষের আকিদা যেমন মজবুত হয়, তেমনি অনেক মানুষ ভ্রান্ত মতবাদ ও বিশ্বাসের পথ ছেড়ে সঠিক পথের সন্ধান পান।

লেখালেখির জগতেও রয়েছে তার সরব পদচারণা। কথাবার্তায় সরলতা ও মেহমানদারিতে তার উদারতা সর্বজনবিদিত। বয়স আশির কাছাকাছি, বয়সের ভারে শরীর কিছুটা ভেঙে পড়েছে, শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। তার পরও থেমে নেই মুফতি তাজুল ইসলামের হাদিসের দরস দেওয়া।

মুফতি তাজুল ইসলাম ১৯৪৫ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি ‘‘হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলাধীন লামাতাশি গ্ৰামে’’ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলভী ইয়াজাতুল্লাহ (রহ.)। পড়াশোনার হাতেখড়ি পিতা-মাতার কাছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, তালিমুল ইসলাম চাহারম (চতুর্থ) পর্যন্ত মায়ের কাছে এবং ফার্সির প্রাথমিক কিতাব কারিমা-পান্দেনামা বাবার কাছে বাড়িতেই পড়েছেন। পরে সিলেটের সুলতান জমিদার বাড়ি স্কুলে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ওই অঞ্চলে তিনিই সর্বপ্রথম পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি লাভ করেন। পরে শায়খুল হাদিস লুৎফুর রহমান বরুণাভির (শায়খে বরুণা) পরামর্শে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়।

হামিদনগর বরুণা মাদ্রাসায় নাহু-সরফের প্রাথমিক কিতাবগুলো তিনি শায়খে বরুণার কাছে পড়েন। এর পর ভর্তি হন কুমিল্লার বরুড়া মাদ্রাসায়। ১৯৬১ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে তিন বছর লেখাপড়া করেন। ১৯৬৪ সালে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদে মিশকাত-দাওরা শেষ করে করাচির নাজিমাবাদ মাদ্রাসায় মুফতি ডিগ্রি অর্জন করেন। দাওরায়ে হাদিস পড়ার সময় রমজানের ছুটিতে মাওলানা আবদুল্লাহ দরখাস্তি (রহ.)-এর কাছে দুই মাস দশ দিন তাফসির এবং বাতিল মতবাদ বিষয়ে বিশেষভাবে পড়াশোনা করেন। বানুরী টাউনে থাকার সময় আল্লামা আবদুর রশিদ নোমানী ও আল্লামা ইউসুফ বানুরী (রহ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এখানে তিনি দীর্ঘদিন শায়খ রশিদ আহমদ লুধিয়ানবী (রহ.)-এর কাছে হাতে-কলমে ফতোয়ার ওপর বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এ সময়ই তিনি ফতোয়ার বিখ্যাত কিতাব ‘আহসানুল ফতোয়ার’ প্রথম খন্ডের সংকলিত ফতোয়াগুলো লিপিবদ্ধ করেন।

১৯৬৭ সালে দেশে ফিরে নিজ গ্রাম শিবপাশায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়। এক বছর পর নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত মউ মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে টানা ৯ বছর দায়িত্বপালন করেন। পরে ময়মনসিংহের জামিয়া আশরাফিয়া খাগডহরে ৮ বছর এবং নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ মাদ্রাসায় ৫ বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৮ সালে মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শামছুদ্দীন কাসেমী (রহ.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জামিয়া আরজাবাদে আসেন।

সমাজে ধর্মের ছদ্মাবরণে থাকা বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি, আলোচনা, বিশেষ প্রশিক্ষণ ইত্যাদিতে আরজাবাদ মাদ্রাসার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। রমজান মাসজুড়ে আরজাবাদ মাদ্রাসায় শায়খুত তাফসির আল্লামা আহমদ আলী লাহোরী (রহ.)-এর তাফসির কোর্সের অনুকরণে তাফসির কোর্স ও ভ্রান্ত মতবাদরোধে প্রশিক্ষণ কর্মশালা চালু করেন আল্লামা শামছুদ্দীন কাসেমী (রহ.)। তার মৃত্যুর পর থেকে মুফতি তাজুল ইসলাম কোর্সটি পরিচালনা করছেন। তার লিখিত বই ‘কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান’ ব্যাপক সাড়া জাগায়। তিনি জামায়াতে ইসলামের বিভ্রান্তিকর বিষয় নিয়ে ‘গোলাম আজমদের আসল চেহারা’ নামে একটি পুস্তকও রচনা করেছেন।

ছাত্র অবস্থায় মাওলানা আবদুল্লাহ দরখাস্তি (রহ.)-এর কাছে আত্মশুদ্ধির নিমিত্তে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মুরিদ হন। দেশে ফিরে নেত্রকোনার কারি সিদ্দিকুর রহমান শায়খে জারিয়া (রহ.)-এর মুরিদ হন এবং খেলাফত লাভ করেন।

মুফতি তাজুল ইসলাম সুদীর্ঘকাল ধরে হাদিসের প্রধান কিতাব সহিহ বোখারি পড়াচ্ছেন। এ ছাড়া তিরমিজি শরিফ ও হেদায়াসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ কিতাব পড়িয়েছেন। তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে হাদিসের ব্যাখ্যা করেন এবং সম-সাময়িক প্রসঙ্গগুলো দারুণভাবে উপস্থাপন করেন। যে কারণে ছাত্ররা অনেক ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে ক্লাসে বসেন। ক্লাসে মুফতি তাজুল ইসলামের তাত্ত্বিক আলোচনা ও রসবোধ বরাবরই মুগ্ধতা ছড়ায়। তিনি বহু বছর ধরে বোখারি শরিফ পড়ান। কিন্তু তার মুখে কখনো শুনিনি, তিনি কত বছর ধরে বোখারি পড়ান। নিজের কৃতিত্ব বলার মধ্যে একটা আনন্দ আছে, কিন্তু তিনি এটা কখনোই উপভোগ করতে যাননি।

থাকার প্রয়োজনে মউ মাদ্রাসায় শিক্ষকতাকালে সেখানে জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন। তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক প্রবীণ এই আলেম এখনো দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত নতুন নতুন গবেষণাপত্র সংগ্রহ করে পড়েন। দেশব্যাপী তার রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। সাধারণ মানুষেরও তার প্রতি আগ্রহ রয়েছে। ছাত্রদের ভক্তি ও সাধারণ মানুষের আকর্ষণকে তিনি কখনো নিজের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য ব্যবহার করেননি। দুনিয়ার প্রতি ন্যূনতম মোহ তার মাঝে নেই। চাকচিক্যময় এই পাষাণ সময়ে তার মতো দুনিয়াবিরাগী ব্যক্তিত্ব মেলা ভার। তার কাছে একাধিক বিষয় পড়া একজন ছাত্র হিসেবে নয়, তার গুণমুগ্ধ ভক্ত হিসেবে নয় একজন সাধারণ বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে এই স্বীকারোক্তি অপকটে দেওয়া যায়।

ইমাম গাজালি (রহ.) বলেছেন, ‘দুনিয়া বর্জনের নাম দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি নয়। দুনিয়ার মধ্যে ব্যস্ত থেকেও এর প্রতি নির্মোহ হওয়ার নাম আত্মত্যাগ। ভালো পোশাক জুটলে পরিধান করবে এবং আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করবে। কিন্তু তা না হলে যেন ভ্রুকুঞ্চিত ও চেহারা বিবর্ণ না হয়। ভালো ঘরের ব্যবস্থা হলে সেখানে বসবাস করবে। না হলে মন যেন দুঃখ ভারাক্রান্ত না হয়। অঢেল সম্পদ আসবে এবং নিঃশেষ হয়ে যাবে। কী আসল আর কী ব্যয় হলো, তা যেন মূল কথা হয়ে না দাঁড়ায়। বরং দুনিয়াকে আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর জন্যই যেন এসব কাজে লাগে।’

উপরোক্ত কথার প্রমাণ মেলে অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী নিভৃতচারী আলেম মুফতি তাজুল ইসলামের কথায়। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘আমি সরল জীবনযাপনে আরামবোধ করি। আমার কাছে কারও কোনো পাওনা নেই। আমি কারও কাছে কিছু পাই না।’ বলি, এভাবে কয়জন বলতে পারেন? এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আল্লাহতায়ালা তার জ্ঞান দ্বারা আমাদের উপকৃত করুন এবং আমাদের ওপর ছায়া দীর্ঘায়িত করুন।