আবদুল মুত্তালিব যখন পুত্র আবদুল্লাহর পক্ষ থেকে মান্নত আদায় সম্পন্ন করলেন, অতঃপর তাঁর বিয়ের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। বনী যোহরা গোত্র সম্ভ্রান্ত বংশীয় হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। ঐ গোত্রের ওহাব ইবন আবদে মানাফের কন্যা, যার নাম ছিল আমিনা—যিনি স্বীয় পিতৃব্য উহায়ব ইবন আবদে মানাফের তত্ত্বাবধানে ছিলেন । তাঁর সাথে পুত্র আবদুল্লাহর বিয়ের পয়গাম পাঠালেন আর নিজে উহায়বের কন্যা, যার নাম ছিল হালা, তার সাথে স্বীয় বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। একই মজলিসে দু’টি নিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। হযরত হামযা ছিলেন তাঁরই গর্ভজাত যিনি সম্পর্কের দিক দিয়ে আবদুল্লাহর চাচাও হতেন, আবার দুধভ্রাতাও।’
হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন, যখন আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহকে বিয়ে করানোর জন্য যাত্রা করেন, পথিমধ্যে এক ইয়াহুদী স্ত্রীলোককে অতিক্রম করেন যার নাম ছিল ফাতিমা বিনতে মুররা। সে তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদিতে অভিজ্ঞ ছিল। আবদুল্লাহর চেহারায় নবৃওয়াতের নূর দেখে সে তাকে নিজের কাছে ডেকে নিল এবং প্রস্তাব করলো যে, আমি তোমাকে একশত উট উপহার দেব। হযরত আবদুল্লাহ তার জবাবে এ কবিতা আবৃত্তি করেন :
“হারাম গ্রহণ অপেক্ষা মৃত্যুই শ্রেয়। আর এমন কাজ মোটেও হালাল নয় যা প্রকাশ করা যায় না। যে অবৈধ কর্মে তুমি আগ্রহী তা আমা দ্বারা সম্ভব নয়। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ তো নিজের আব্রু এবং নিজের দীনের হিফাযত ও সংরক্ষণ করে।
অতঃপর আবদুল্লাহ যখন আমিনাকে বিয়ের পর প্রত্যাবর্তন করছিলেন, পথে পুনরায় ঐ স্ত্রীলোকটির সাথে সাক্ষাত হলো। তখন সে বলল, হে আবদুল্লাহ ! তুমি এখান থেকে যাওয়ার পর কোথায় ছিলে ? হযরত আবদুল্লাহ বললেন, এ সময়ের মধ্যে আমি ওহাব ইবন আবদে মানাফের কন্যা আমিনাকে বিয়ে করেছি। এরপর সেখানে তিনদিন অবস্থান করেছি। এ কথা শুনে ঐ ইয়াহুদী স্ত্রীলোকটি বলল, আল্লাহর কসম, আমি কোন অসৎ চরিত্রা স্ত্রীলোক নই। তোমার চেহারায় নবৃওয়াতের নূর দেখে ইচ্ছে করেছিলাম যে, ঐ নূর আমা থেকে প্রকাশিত হোক। কিন্তু আল্লাহ্ যেখানে চেয়েছেন, সেখানেই ঐ নূর গচ্ছিত রেখেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়া গমন করেন। পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লে মদীনায় যাত্রাবিরতি করেন। বাণিজ্য কাফেলা যখন মক্কায় প্রত্যাবর্তন করে তখন আবদুল মুত্তালিব জিজ্ঞেস করলেন আবদুল্লাহ কোথায়? কাফেলার লোকজন জবাব দিল, অসুস্থতার কারণে তিনি মদীনায় তার মাতুল গোষ্ঠী বনী নাজ্জারে রয়ে গেছেন। আবদুল মুত্তালিব তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র হারিসকে দ্রুত মদীনায় প্রেরণ করেন। মদীনায় পৌঁছে তিনি জানতে পান, হযরত আবদুল্লাহ ইনতিকাল করেছেন। একমাস রোগ ভোগের পর তিনি ইনতিকাল করেন এবং মদীনায় দারে নাবিগায়’ তাঁকে দাফন করা হয় । হারিস ফিরে এসে পিতা আবদুল মুত্তালিব এবং অপরাপর আত্মীয়-স্বজনকে এ দুঃখজনক খবর জানান। যাতে সবাই খুবই দুঃখিত ও বিষণ্ন হয়ে পড়েন।
ইনতিকালের সময়ে আবদুল্লাহর বয়স মতভেদে ৩০, ২৫, ২৮ কিংবা ১৮ ছিল। হাফিয আলাঈ এবং আসকালানী বলেন, বিশুদ্ধ মত এটাই যে, মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর এবং আল্লামা সুয়ূতীও এ মতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। মৃত্যুকালে আবদুল্লাহ পরিত্যাক্ত সম্পদ হিসেবে রেখে যান পাঁচটি উট, কয়েকটি ছাগল এবং একটি বাঁদী যার উপনাম ছিল উম্মে আয়মান আর মূল নাম ছিল বরকত।
আসহাবে ফীল-এর ঘটনা
রাসূলে করীম (সা)-এর জন্মগ্রহণের পঞ্চাশ অথবা পঞ্চান্ন দিন পূর্বে আসহাবে ফীল-এর ঘটনা সংঘটিত হয়। আফ্রিকার আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর পক্ষ থেকে আবরাহা নামক এক ব্যক্তি ইয়েমেনের শাসনকর্তা ছিল। সে যখন দেখল যে, সমস্ত আরববাসী হজ্জ করার জন্য মক্কা মুকাররামায় চলে যায় এবং কাবাগৃহ তাওয়াফ করে। তখন সে ইচ্ছে করলো যে, খ্রিস্টধর্মের নামে একটি বিরাট ইমারত তৈরি করবে যা খুবই মূল্যবান পাথর দিয়ে পরিশ্রম করে বানানো হবে; যাতে আরববাসীগণ সাদামাটা কাবাঘর ছেড়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত ঘরটির তাওয়াফ শুরু করে। সুতরাং সে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় একটি সুন্দর গীর্জা নির্মাণ করালো। যখন এ খবর আরবে ছড়িয়ে পড়লো, তখন কিনানা গোত্রের এক ব্যক্তি সেখানে যায় এবং আবরাহার নির্মিত ঘরটিতে মলত্যাগ করে পালিয়ে এলো।
কেউ কেউ বলেন, আরবের যুবকরা ঐ গীর্জার নিকটবর্তী স্থানে আগুন জ্বালালে আগুনের ফুলকি উড়ে গিয়ে গীর্জায় পড়ে এবং তা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আবরাহা ক্রোধভরে শপথ নিল যে, কাবাগৃহকে ধ্বংস ও মিসমার না করে সে দম ফেলবে না। এ উদ্দেশে আবরাহা মক্কার দিকে সেনা অভিযান পরিচালনা করে। পথিমধ্যে যে সব আরব গোত্র বাধা দান করে, তাদেরকে পর্যুদস্ত করে মক্কায় পৌঁছে যায়। এ বাহিনীর সাথে হাতিও ছিল। মক্কার উপকণ্ঠে মক্কাবাসীদের গবাদিপশুর চারণ ভূমি ছিল। আবরাহার বাহিনী পশুগুলোকে লুট করে নেয়, যেগুলোর মধ্যে মহানবী (সা)-এর সম্মানিত পিতামহ আবদুল মুত্তালিবেরও দু’শো উট ছিল। ঐ সময়ে তিনি কুরাইশ গোত্রের সর্দার ও কাবাগৃহের মুতাওয়াল্লী ছিলেন। আবরাহার আগমনের খবর শুনে তিনি সমস্ত কুরায়শকে একত্র করে বললেন ভয় পেয়ো না, তোমরা মক্কা খালি করে দাও, কাবাঘর কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। এটা আল্লাহর ঘর এবং তিনিই এর হিফাযত করবেন। এরপর আবদুল মুত্তালিব কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কুরায়শসহ আবরাহার সাথে সাক্ষাত করতে যান। ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলো। আবরাহা আবদুল মুত্তালিবকে জাঁকজমকপূর্ণ সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে। আল্লাহ তাআলা আবদুল মুত্তালিবকে নযির বিহীন রূপ-সৌন্দর্য, আশ্চর্যজনক শক্তি-ক্ষমতার অধিকারী ও প্রাঞ্জলভাষী করেছিলেন, যা দেখে প্রতিটি ব্যক্তিই ভক্তি গদগদ হয়ে পড়তো। আবরাহাও তাঁকে দেখে ভক্তি গদগদচিত্ত হয়ে পড়লো এবং খুবই শ্রদ্ধা ও বিনয় সহ সামনে এলো। এটা তো সম্ভবপর মনে হয়নি যে, তাকে নিজ আসনে একসাথে বসতে দেয়। অবশ্য এতটুকু সম্মান করেছিল যে, নিজে আসন থেকে নেমে এসে কুরায়শদের সাথে কার্পেটে বসে তাদেরকেও নিজের সাথে বসায়। কথা প্রসঙ্গে আবদুল মুত্তালিব তাঁর উটগুলো ফেরত দেয়ার প্রস্তাব করলেন। আবরাহা অবাক হয়ে বলল, বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, তুমি আমার সাথে নিজের উটগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য আলোচনা করছ; অথচ কাবাগৃহ, যা তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মীয় ভিত্তি, সে ব্যাপারে তো একটি কথাও বললে না! আবদুল মুত্তালিব উত্তর দিলেন আমি উটগুলোর মালিক, এজন্যে সেগুলো ফেরত পাওয়ার আগ্রহ করছি। আর কাবাঘরের মালিক তো আল্লাহ্; তিনি অবশ্যই তা রক্ষা করবেন। আবরাহা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবদুল মুত্তালিবের উটগুলো ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিল। আবদুল মুত্তালিব উটগুলো নিয়ে ফিরে এলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি কুরায়শদের মক্কা ত্যাগ করতে পরামর্শ দিলেন। উটগুলো কা’বাগৃহের উদ্দেশে উৎসর্গ করলেন এবং কয়েকজন ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে কা’বার দরজায় উপস্থিত হয়ে মুনাজাতের মাধ্যমে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আর এ কবিতার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন
“হে আল্লাহ, বান্দা তার জায়গার হিফাযত করে, তুমি নিজ গৃহের হিফাযত কর। ক্রুশের অধিকারী এবং ক্রুশের উপাসনাকারীদের মুকাবিলায় তোমার অনুসারীদের সাহায্য কর। ওদের ক্রুশ এবং ওদের প্রচেষ্টা তোমার ইচ্ছার উপর কখনই বিজয়ী হতে পারবে না। সৈন্য-সামন্ত ও হাতি নিয়ে ওরা এসেছে তোমার (ঘরের) প্রতিবেশিদের গ্রেফতার করতে। ওরা এসেছে তোমার হেরেমকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে; মূর্খতার কারণেই তারা এ সংকল্প করেছে; তোমার বড়ত্ব, মহত্ব ও শক্তিমত্তার প্রতি তারা আদৌ ভ্রুক্ষেপও করছে না।”
প্রার্থনা শেষে আবদুল মুত্তালিব নিজ সঙ্গী-সাথীসহ পাহাড়ে আরোহণ করলেন। এদিকে আবরাহা সৈন্য-সামন্ত নিয়ে কা’বাগৃহ ধ্বংস করার জন্য অগ্রসর হলো। মুহূর্তের মধ্যেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট ছোট পাখি দৃষ্টিগোচর হলো। প্রতিটি পাখির ঠোঁটে ও দু’পায়ের থাবায় ছিল ছোট ছোট পাথর —যা ক্ষণে ক্ষণে সৈন্যদের উপর পতিত হতে লাগলো। আল্লাহর কি মহিমা! ঐ ছোট ছোট পাথরই বন্দুকের নিক্ষিপ্ত গুলীর মত কাজ করতে লাগলো। এগুলো আবরাহা বাহিনী ও তাদের সওয়ারীর মাথায় পড়ে দেহ ভেদ করে বের হতে শুরু করলো। ঐ পাথর যার উপর পড়তো, সাথে সাথেই সে মৃত্যুবরণ করতো। মোটকথা, এভাবেই আবরাহার সৈন্য-সামন্ত ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আবরাহার শরীরে দেখা দিল বসন্তের শুটি। ফলে তার সমস্ত শরীর পচে গেল এবং শরীর থেকে রক্ত ও পুঁজ গড়াতে থাকলো। এরপর তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এক এক করে খসে পড়তে শুরু করলো। সবশেষে তার দেহের অভ্যন্তর থেকে কলিজা ফেটে বেরিয়ে পড়লো আর সাথে সাথে আবরাহা মৃত্যুর হিম শীতল কোলে ঢলে পড়লো। সবাই যখন ছিন্নভিন্ন দেহে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো, তখন মহাশক্তিধর আল্লাহ এক ভারী বর্ষণে ধ্বংসাবশেষের সবকিছু ধুয়ে মুছে সাগরে পৌঁছিয়ে দিলেন।
সূত্র: সীরাতুল মুস্তফা সা.
সংকলনে: আহমাদ আল গাজী