আরবি ভাষা মুসলমানের আত্মপরিচয়

–মহিউদ্দীন ফারুকী
ভাষা আল্লাহতায়ালার অনন্য দান, শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে। এই ভাষা মানুষের চিন্তা চর্চার বাহন, মানব পরিচয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম : ২১-২২)। ভাষা শুধু মনের ভাব প্রকাশক আর চিন্তার বাহনই নয়, বরং একটি জাতির প্রতীক; জাতির অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। ভাষার পরিচয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে একটি জাতির জাতিসত্তা। সেই নির্দিষ্ট ভাষাকে অবলম্বন করে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বিশ্বের কাছে তাদের জাতীয় অস্তিত্ব তুলে ধরে। ভাষা সেই জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাহন; শিল্পকর্ম ও অগ্রগতির ধারক।

আরবি ভাষা
আরবি ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। সব ভাষাবিদদের দৃষ্টিতে এ ভাষা হচ্ছে চিরযৌবনা ভাষা। এর কোনো শৈশব বা বার্ধক্য নেই। এ ভাষায় কোরআনে কারিমের অবতরণ একে আরও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। পৃথিবীতে প্রায় ২৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে। আরবের সবগুলো দেশসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশের জাতীয় ও মাতৃভাষা হচ্ছে আরবি ভাষা। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ছয়টি ভাষার মধ্যে অন্যতম চতুর্থ ভাষা হচ্ছে আরবি। এক কথায়, আরবি আজ শুধু আরব জাতি ও মুসলিম জাতির ভাষা নয়; এ ভাষা আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভাষায় পরিণত হয়েছে। আরবি ভাষার অনন্য বৈশিষ্ট হচ্ছে, তা সৃজনশীল। রয়েছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারার সক্ষমতা। সভ্যতার যোগাযোগে এর ভূমিকা অনন্য। এ ভাষার রয়েছে শব্দ-বাক্যের বিশালতা; যা অনিঃশেষ বিবরণ দিতে থাকে, কিন্তু ফুরায় না। কবি হাফেজ ইবরাহিমের ভাষায়, ‘আমি সমুদ্রের মতো বিশাল, আমার গভীরে রয়েছে অসংখ্য মণিমুক্তা। তারা ডুবুরিকে জিজ্ঞেস করেছে আমার এ সম্পদের বিষয়ে?’ কোরআনের ভাষা হওয়ার সুবাদে এ ভাষার কোনো মৃত্যু নেই। এর প্রবাহ অবিনাশী ও অবিনশ্বর। এর বিকাশধারা চির বহমান।

আত্মপরিচয়ে ভাষা
আরবি ভাষা আরব জাতির এমনকি মুসলিম জাতির আত্মপরিচয়। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তাদের মূল্যবোধ। আরবি ভাষা মিশে আছে আরব জাতির অস্তিত্ব-চেতনায়। এর আবেদন আবহমান-চিরায়ত, শাশ্বত। স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তাদের প্রতি দায়বদ্ধতার চেতনা এ ভাষার মাধ্যমেই গড়ে ওঠে। প্রত্যেক জাতির অনন্য পরিচায়ক এ ভাষাসম্পদ। অতএব, আরবি ভাষাকে কেন্দ্র করেই আরবরা স্বতন্ত্র জাতি হয়ে উঠেছে।

সংকট ও আগ্রাসন
বিশ্বায়নের দাপুটে প্রভাবে সব দেশই তাদের মাতৃভাষা নিয়ে চিন্তিত। বিশ্বের সংযোগ-ভাষা হয়ে ওঠায় ইংরেজির দাপট বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর ছোট-বড় অনেক ভাষা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। আরবি ভাষাও এ সংকট মুক্ত নয়। আরব বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইংরেজির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। অনেক অফিসের কাজের ভাষা হয়ে গেছে ইংরেজি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে ইংরেজিতে। মিডিয়ায়, নাটকে, অনুষ্ঠানাদিতে চলছে ইংরেজি ও বিদেশি ভাষার আধিক্য। মিডিয়াকর্মী, গবেষক এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বক্তাদের ভাষায় আজ ইংরেজি শব্দের ছড়াছড়ি। তরুণ-তরুণীদের মাঝে ইংরেজিপ্রীতি বাড়ছে ভয়ানকভাবে। তাদের কথায়, আচরণে বিদেশি ভাষার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আরবি ভাষা তাদের কাছে অবহেলিত। আরবির অশুদ্ধ বানান, অশুদ্ধ শব্দপ্রয়োগ, অশুদ্ধ বাক্যগঠন সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে। দোকান, রেস্তোরাঁর বিলবোর্ডে, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে আরবি হরফে দেখা যাচ্ছে ইংরেজি শব্দ বা বাক্য অথবা সরাসরি ইংরেজি নামের ব্যবহার। স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আজ বিশুদ্ধ আরবির পরিবর্তে আঞ্চলিক এবং বিদেশি শব্দ ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। আরবি ভাষা পরিস্থিতি এখন চরম নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তিকর অবস্থার শিকার। বিদেশি ভাষার আগ্রাসন মূলত আরব জাতির জন্য এক বিরাট ভাষিক সংকট।

সমাধান ও উত্তরণ
আরবি ভাষার মতো এমন একটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও মহিমান্বিত ভাষার এ সংকট মোকাবিলায় সবাইকেই কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। আরবির ক্ষেত্রে এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে আরব দেশগুলোকে বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এ সংকট এবং ভাষাগত নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচতে আরব বিশ্বের ভাষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আরবি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন আয়োজন, সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সর্বস্তরে সচেতনতা, উপযুক্ত কর্মপ্রয়াস জোরদারের বিকল্প নেই।

বাস্তবতা ও নিরসন
আরবি ভাষা ব্যবহারে বা শেখায় অনেকেরই হীনমন্যতা কাজ। মূলত সবার হৃদয় থেকে এটা ত্যাগ করতে হবে। আরবি ভাষা এবং আরব জাতির আত্মপরিচয় বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সবাইকে আরবি ভাষা শেখায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মিডিয়া, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলোতে বিশুদ্ধ আরবি ব্যবহার করতে হবে। কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে যেই ভাষা অনন্য শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে, তার শুদ্ধ প্রয়োগ এবং বিশুদ্ধ উচ্চারণে গুরুত্ব দিতে হবে। বিকৃতি থেকে একে রক্ষা করতে হবে। আরব দেশগুলোর তত্ত্বাবধানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন আয়োজন এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের আরবির প্রচার প্রসারে কাজে লাগাতে হবে। যত্নের সঙ্গে আরবি শুদ্ধভাবে শিখতে হবে, বলতে হবে, লিখতে হবে। এ ভাষাকে চির সজীব রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। কারণ, এ ভাষা আরব জাতি ও মুসলিমদের শুধু প্রিয় ভাষা নয়; বরং তাদের আত্মপরিচয়।


লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ, ঢাকা