ইসলাম ও প্রতিবেশি 

ইসলাম যেখানে আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য উত্তম নির্দেশনা ও শিক্ষা দিয়েছে, সেখানে প্রতিবেশিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের ওপরও জোর দিয়েছে। কেননা এতে একে অপরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা‌ বৃদ্ধি পায়, ভালোবাসা বাড়ে এবং মানবতার উন্মেষ ঘটে। সুতরাং কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَاعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئاً وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًاً وَبِذِي الْقُرُبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُربى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمُ إِنَّ اللَّهَ لاَ يُحِبُّ مَنْ كَان مُخْتَالاً فَخُورًا

এবং আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি, পথচারী এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও (সদ্ব্যবহার কর)। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দর্পিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (নিসা-৩৬)

(এই সমস্ত হকদার ব্যক্তিরা যদি মুসলমান না হয় তাহলে তাদের উপর দয়া করবে। কেননা কোনো আত্মীয়র হক আত্মীয়তার কারণে যেভাবে বেশি হয়ে থাকে, তেমনিভাবে মুসলমানের হক ইসলামের কারণে বেশি)

আয়াত থেকে বুঝে আসে- পাশের ঘরে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী প্রতিবেশিরই হক নয় বরং মজলিসের সঙ্গীর হক আদায় এবং তার সাথে ভালো ব্যবহারের আদেশ করা হয়েছে। এই আয়াতের আলোকে এ কথা স্মরণে রাখা চাই যে, ট্রেন বা বাসে পাশের সিট বা বরাবর সামনে বসা ব্যক্তিও মজলিসের সঙ্গী । আল্লাহ তায়ালা কুরআনে তার হক আদায়ের হুকুম দিয়েছেন। এখানেও মুসলিম অমুসলিমের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেননি। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাব কুরআনে হুকুম দিয়েছেন যে, ধর্মের দিকে খেয়াল না করে প্রত্যেক মানুষকে তার প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করা তোমাদের জন্য ফরজ। তোমাদের জীবনের সর্বদা তা স্মরণে রাখা চাই।

আচার ব্যবহার ও জীবন যাপনের এই করআনি শিক্ষাকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তরে মহব্বত ও ভালোবাসা তৈরি হয়। মানুষকে মানবতার ভিত্তিতে সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করা চাই। নবী-রাসূলগণ এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের সবসময়ের নিয়ম এমনই ছিল । তারা এভাবেই লোকদের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে।

প্রতিবেশী সম্পর্কে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু ইরশাদ

মানবতার মুক্তির দূত, উভয় জাহানের সরদার হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদাই তার শিক্ষা ও হেদায়াতে প্রতিবেশীর সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদেরকে সম্মান করা এবং তাদের হক আদায়ের ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন:

عَنْ عَائِشَةَ وَابْن عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِي بِالْجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ انه سيورثه

হযরত আয়েশা রাযি. ও হযরত ইবনে উমর রাযি. হতে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: জিবরাঈল আ. আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অবিরত নসীহত করতে থাকেন। আমি মনে মনে ভাবলাম যে, তিনি তাকে হয়তো ওয়ারিস বানিয়ে দিবেন। (তিরমিজি বাবু মা জা’আ ফি হক্কিল জিওয়ার, পৃষ্ঠা-১৬, খন্ড-২, বুখারি পৃষ্ঠা-৮৮৯, খন্ড-২)

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: وَاللَّهِ لَا يُؤْمِنُ، وَاللَّهِ لا يُؤْمِنُ، وَاللَّهِ لَا يُؤْمِنُ، قِيلَ وَمَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: الَّذِي لَا يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ

হযরত আবু হোরাইরাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মুমিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মুমিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলো- কোন ব্যক্তি? হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন: যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদে থাকে না। (বুখারি বাবু মান লা য়া’মানু জা-রাহু, পৃষ্ঠা-৮৮৯, খন্ড-২)

এই হাদিসের শিক্ষা এটাই যে, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরি হচ্ছে- প্রতিবেশীর সাথে তার আচার ব্যবহার এমন হবে যে, তারা তার থেকে পুরোপুরি নিরাপদ ও ভয়ভীতিহীন থাকবে। মুসলমানদের ঈমান এমনটাই শিক্ষা দিয়ে থাকে। আর এটা স্পষ্ট যে, প্রতিবেশীর সাথে যার আচার-ব্যবহার ভালো নয়, তাকে পরিপূর্ণ মুমিন বলা যায় না।

عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ حَيْدَةَ رضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: حَقٌّ الْجَارِ إِنْ مَرِضَ عُدْتَهُ، وَإِنْ مَاتَ شَيَّعْتَهُ، وَإِنِ اسْتَقْرَضَكَ أَقْرَضْتَهُ، وَإِنْ أَعْوَزَ سَتَرْتَهُ، وَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ هَنَّأْتَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ مُصِيبَةٌ عَزَّيْتَهُ، وَلَا تَرْفَعُ بِنَانَكَ فَوْقَ بِنَائِهِ، فَتَسُدَّ عَلَيْهِ الرِّيْحَ، وَلَا تُؤْذِهِ بِرِيحٍ قَدْرِكَ إِلَّا أَنْ تَغْرِفَ لَهُ مِنْهَا

হযরত মুয়াবিয়া বিন হায়দা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: প্রতিবেশির হক হচ্ছে- যদি সে অসুস্থ হয়, তাহলে তাকে দেখতে যাও। যদি সে মারা যায়, তাহলে তার জানাজার সাথে যাও। যদি সে ঋণ চায়, তাহলে তাকে ঋণ প্রদান করো। যদি সে কোনো খারাপ কাজ করে, তাহলে তা আড়াল করো। যদি সে খুশি হয়, তাহলে তাকে মোকারকবাদ দেও। যদি বিপদে পতিত হয়, তাহলে তাকে স্বান্তনা দেও। নিজের ঘর এমনভাবে নির্মাণ করো না যাতে তার ঘরের আলো বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। (যখন তোমার ঘরে ভালো কিছু রান্না হয়, তাহলে চেষ্টা করবে) যাতে তোমার পাতিলের ঘ্রাণ তার কষ্টের কারণ না হয়। তবে কিছু খানা তার ঘরে পাঠাবে। (তাবরানি ফিল কাবির, পৃষ্ঠা-৪২০, খন্ড-১৯, বাবুল মিম)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই সমস্ত হেদায়েতের মাধ্যমে ধারণা করা যায়- ইসলাম দুনিয়াতে মানুষের হককে কত বেশি বিবেচনা করে এবং মানুষকে সম্মানের ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা এত উন্নত যে, এর অন্য কোনো দৃষ্টান্ত পেশ করা যাবে না। এ ধরনের শিক্ষাই মুসলমানরা তাদের জীবনে বাস্তবায়ন করেছে। ফলশ্রুতিতে তারা যেখানে গিয়েছে, সেখানে বিপ্লব তৈরি করেছে এবং দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে।

عَنْ أنَس بْن مَالِكٍ رضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم: مَن اٰذَى جَارَه فَقَد اٰذانِي، وَمَن اٰذانِي فقَد اٰذى اللّه، وَمَن حَارَب جَارَه فقَد حَاربَنِي، وَمَن حَارَبَنِي فقَد حَاربَ اللّهَ عزَّ و جلَّ

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে তার প্রতিবেশিকে কষ্ট দিলো, সে যেন আমাকেই কষ্ট দিলো। আর যে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, যেন সে আল্লাহ তায়ালাকে কষ্ট দিয়েছে। আর যে তার প্রতিবেশির সাথে লড়াই করেছে, যেন সে আমার সাথে লড়াু করেছে। আর যে আমার সাথে লড়াই করেছে, যেন সে (নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহ তায়ালার সাথে লড়াই করেছে। (আত তারগিব ওয়াত তারহিব, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২৪১)

আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ইরশাদ প্রতিবেশিকে সম্মান করা এবং তার হক হেফাজতের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ । এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- প্রতিবেশীর হক আদায় না করলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নেক দৃষ্টি ও রহমত থেকে বঞ্চিত হয়।

عَنْ أَبِي شُرَيْحٍ الْخُزَاعِي أَنَّ النَّبِيّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيُحْسِنُ إِلَى جاره

হযরত আবু শুরাই খুজায়ি রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, তার উচিত প্রতিবেশির সাথে সদাচরণ করা। (মুসলিম কিতাবুল ঈমান, বুখারি পৃষ্ঠা-৮৮৯, খন্ড-২)

এর উদ্দেশ্য দাঁড়ালো এমন- যদি বাস্তবেই মানুষ আখেরাতের পুরস্কার ও শাস্তি সম্পর্কে ঈমান রাখে, তাহলে প্রতিবেশীর হক নষ্ট করতে ভয় পাবে ‌ । কেননা আল্লাহর কাছে তার জবাবদিহি করতে হবে।

একজন সত্যিকারের মুসলমানের আচরণ তার প্রতিবেশীর সাথে-চাই সে যে কেউ হোক এবং যে কোনো ধর্মেরই হোক- ভালো হওয়া চাই। কেননা কিয়ামতের দিন মুসলমানের এই ভালো আচরণের প্রতিদান দেওয়া হবে।

এই আয়াতের (وَاعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ …الخ) শেষে আল্লাহ তায়ালা কথা: “আল্লাহ তায়ালা কোনো দাম্ভিক ও অহংকারিকে পছন্দ করেন না” থেকে বুঝা যাচ্ছে- আয়াতে যে সমস্ত কাজের আদেশ করা হয়েছে, তা আদায় করতে ঐ সমস্ত ব্যক্তিরাই অলসতা করে, যারা অহংকারী। অর্থাৎ নিজেকে সবার থেকে উঁচু এবং অন্য সকলকে নিজের থেকে ছোট ও তুচ্ছ মনে করে।

অহংকার আল্লাহ তায়ালা একদমই পছন্দ করেন না। মানুষ; মাথা থেকে নিয়ে পা পর্যন্ত এবং জন্ম থেকে মৃত্যু আল্লাহর মুখাপেক্ষী আর মুখাপেক্ষী। নিজে নিজেকে সবার থেকে বড় এবং অন্যকে তুচ্ছ মনে করে। তার জন্য আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করে দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যার অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ অহংকার রয়েছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (মুসলিম)

تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا

ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সকল লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। (কসাস-৮৩)

এ আয়াতগুলো থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, অহংকার মানুষকে আল্লাহর ইচ্ছা ও পছন্দের রাস্তা থেকে বঞ্চিত করে দেয়। তাকে এমন ভালো কাজ থেকেও দূর করে দেয়, যা আল্লাহর পছন্দনীয়। যার মৃত্যুর পরের পরিণাম হচ্ছে জাহান্নাম ও আল্লাহর শাস্তি।

প্রত্যেক মানুষকে তার মন মস্তিষ্ক থেকে অহংকার কে বের করা যায় এবং বিনয়কে নিজের অন্তরে ধারণ করা চাই। যাতে সে আল্লাহর বান্দাদের হক আদায় করতে পারে এবং জান্নাতের উপযুক্ত হতে পারে।