ঈদের সূচনা, গুরুত্ব ও ফজিলত

ঈদ সারাবিশ্বের মুসলমানের সার্বজনীন আনন্দ-উৎসব। নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদগাহে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে।

ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরে প্রেমের বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং সালাম, মুসাফাহা, মুয়ানাকার মাধ্যমে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। মাহে রমজানের এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ থেকে মুক্ত হতে পারার পবিত্র অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদুল ফিতরের খুশি।

ঈদ عيد শব্দটি আরবি عود থেকে নির্গত। অর্থ হলো, বারবার আসা। যেহেতু এইদিন দুটি প্রতিবছর বারবার আসে, এজন্য এই দুইদিনকে ঈদ বলা হয়। عود থেকে নির্গত عيد নামকরণের আরো একটি কারণ হলো, এদিন আল্লাহ তাযআলা রহমত ও ক্ষমা নিয়ে বান্দার প্রতি অভিমুখী হন। (মাজাহেরে হক:২/২৭৭)

‘ঈদুল ফিতর’ শব্দ দুটিই আরবি, যার অর্থ হচ্ছে উৎসব, আনন্দ, খুশি, রোজা ভেঙে ফেলা ইত্যাদি। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগীর পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ শাওয়াল মাসের চাঁদের আগমনে রোজা ভেঙে আল্লাহর বিশেষ শোকরিয়াস্বরূপ যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন- শরিয়তের পরিভাষায় তাই ঈদুল ফিতর।

শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখকে ‘ঈদুল ফিতরের’ দিন বলা হয়। জিলহজ্ব মাসের দশম তারিখকে ‘ঈদুল আজহা’ বলা হয়। এই দুইদিনকে একত্রে ঈদাইন বলা হয়। এই দুইদিন শুকরিয়া স্বরূপ ২ রাকাত নামাজ আদায় করা ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহ আলাইহির মতে ওয়াজিব। অন্যান্য ইমামদের নিকট সুন্নতে মুয়াক্কাদা।

ঈদের সূচনা কিভাবে হলো

ইসলাম ধর্মে ঈদের প্রবর্তন বা সূচনা হয়েছে দ্বিতীয় হিজরি সনের মাঝামাঝি সময়ে।

عن أنس بن مالك: قدِمَ رسولُ اللهِ صلّى اللهُ عليه وسلَّمَ المدينةَ ولهم يومانِ يلعَبونَ فيهما في الجاهليَّةِ، فقال: إنَّ اللهَ قد أَبدَلَكم بهما خَيرًا منهما: يومَ الفِطرِ، ويومَ النَّحرِ

‘আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আসেন, তখন দেখেন যে সেখানকার লোকেরা বছরে ২দিন (নাইরোজ ও মিহরজান নামে ২টি দিনে) আনন্দ করে, খেলাধুলায় মগ্ন থাকে।

এহেন পরিস্থিতি দেখে দুজাহানের বাদশাহ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের এ দুদিনের পরিবর্তে আরো বেশি উত্তম ও কল্যাণকর ২টি দিন দিয়েছেন। ১. ঈদুল আজহা ২. ঈদুল ফিতর। (আবু দাউদ, ১/১৬১. হাদিস নম্বর ১১৩৪ সুনানে নাসায়ী: ১ম খ-, পৃ. ১৭৭)

ইসলাম যে তার অনুসারীদের ধর্ম-কর্ম পালনের পাশাপাশি আনন্দ উদ্‌যাপনেরও সুযোগ দিয়েছে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ২টি তারই এক বড় নিদর্শন। ঈদের দিন বৈধ পন্থায় আনন্দ উদ্‌যাপনের এই অবকাশ প্রসঙ্গেই আম্মাজান আয়েশা (রা.) নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বর্ণনা করেছেন-

لَتَعْلَمُ يَهُودُ أَنَّ فِي دِينِنَا فُسْحَةً، إِنِّي أُرْسِلْتُ بِحَنِيفِيَّةٍ سَمْحَةٍ.

অর্থ: ইহুদিরা জানবে, ‘আমাদের ধর্মেও অবকাশ আছে। নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি এমন এক শরিয়ত নিয়ে, যা সহজতা ও উদারতার গুণে গুণান্বিত’। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৪৮৫৫)

ঈদের আসল উদ্দেশ্য কি?

মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতরের এই দিনটি মূলত আল্লাহ দিয়েছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের জন্য। তিনি যে রমজানের সবক’টি রোজা রাখার এবং তার ইবাদতে পুরো একটি মাস কাটানোর তাওফীক দিয়েছেন সেজন্য শোকর আদায়- এটাই ঈদের তাৎপর্য। এই মাসে রোজা রাখতে পারা এবং আল্লাহর ইবাদতের অসীম-অবারিত সুযোগ পাওয়ার যে আনন্দ মুমিন-হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়- ঈদুল ফিতর হল সেই আনন্দ প্রকাশ করার উৎসব। সে আনন্দের প্রকাশ ঘটে দলে দলে ঈদগাহে হাজির হয়ে মহান রবের কৃতজ্ঞতায় সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে। তার মহিমা ও বড়ত্বের ঘোষণা দিয়ে তাকবীর পাঠের মাধ্যমে এবং এই সিয়ামসাধনা যেন কবুল হয় সেজন্য একে অপরের কাছে দোয়া চাওয়ার মাধ্যমে।

ঈদের দিন কুশল বিনিময়ের ভাষার মধ্যেই এ বার্তা রয়েছে-

تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكُمْ.

অর্থ: ‘আল্লাহ কবুল করুন- রমজান মাসে ও আজকের দিনে করা আমাদের ও তোমাদের সমস্ত নেক আমল’।

কুশল বিনিময়ের এই বাক্যটিই ইসলামের ঈদকে অন্যান্য ধর্মের উৎসব থেকে আলাদা করে দেয়। মুসলমানের ঈদ আশা ও ভয়ে মিশ্রিত এক সতর্ক ও সংযত আনন্দ উদ্‌যাপন। একদিকে খুশি- আলহামদুলিল্লাহ, রোজাগুলো রাখতে পেরেছি। অন্যদিকে শঙ্কা- কবুল হয়েছে তো! রমজান পেয়েও যদি মাগফিরাত নসীব না হয়, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য তো কিছু নেই…।

মাসব্যাপী ইবাদতের তাওফিক পেয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং সেই খুশিতে তার বড়ত্ব বর্ণনা করে তাকবীর পাঠ, এটাই যে ঈদের মর্মকথা- নিম্নোক্ত আয়াতই তার প্রমাণ-

وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُون.

অর্থ: ‘এবং যাতে তোমরা রোজার সংখ্যা পূরণ করে নাও আর আল্লাহ যে তোমাদের পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অংশ হিসেবেই এদিন বৈধ সব উপায়ে আনন্দ করতে দেয়া হয়েছে। একজন মুমিন শরিয়তের সীমার ভেতরে থেকে যেভাবে আনন্দ করতে পারে। ভালো খাওয়া, ভালো পরা, আপনজন ও প্রিয়জনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও খোশগল্প, একে অপরকে হাদিয়া দেয়া, আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেয়া ইত্যাদি।

এই আনন্দে যেন সমাজের সব শ্রেণির মানুষ শরীক হতে পারে, সেজন্যই সদাকাতুল ফিতরের বিধান। শুধু নিজে ভালো খাওয়া ও ভালো থাকার যে আনন্দ- অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর আনন্দ তার চেয়ে বহুগুণে বেশি। এ কারণেই দান-সদকা ও জাকাত-ফিতরার প্রতি এত উৎসাহিত করেছে শরিয়ত।