এডিআর লঙ্ঘন: তারল্যের তীব্র সঙ্কটে ১৭ ব্যাংক

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও সম্প্রতি দেশের ১৭টি ব্যাংক আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করেছে। এর জেরে তারল্যের তীব্র সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। খবর ইউএনবি।

প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ঋণ বিতরণে অতি-আগ্রাসী ভূমিকায় মেতে ওঠা ১৭ ব্যাংক এখন বন্টনকৃত ঋণের অর্থ আদায় করতে পারছে না। পাশাপাশি, এসব ব্যাংক প্রয়োজন মতো নতুন আমানত আকর্ষণ করতে পারছে না।

নিয়ম অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে ঋণ-আমানত অনুপাত নির্ধারণ করে দিয়েছে, ব্যাংকগুলোকে তা বজায় রাখতে হয়। কোনো কারণে ঋণের পরিমাণ আমানত অনুপাতে বেশি হয়ে গেলে, নতুন করে আমানত সংগ্রহ ও নির্ধারিত অনুপাতে পৌঁছার আগে পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের উচিত ঋণ বিতরণে বিরত থাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি মোতাবেক, প্রথাগত ব্যাংকগুলো প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। অন্যদিকে শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকগুলো প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৯২ টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারে। ব্যাংকিং পরিভাষায় বিষয়টিকে অ্যাডভান্সড ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বা ঋণ-আমানত অনুপাত বলা হয়।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি সময়কাল নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ১৭টি ব্যাংক ঋণ-আমানত অনুপাত লঙ্ঘন করে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো চরম রকমের তারল্য সংকটে নিপতিত হয়েছে। সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলো এখন নতুন ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। এমনকি কয়েকটি ব্যাংক আমানতকারীর অর্থ পরিশোধেও ব্যর্থ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বিদ্যমান এ অবস্থা আমানতকারীদের জন্য নতুন ঝৃঁকি সৃষ্টি করেছে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও ভুতুড়ে ঋণ বা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ঋণ দেওয়ার কারণে ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া ভেস্তে পড়েছে বলে তারা মনে করেন।

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ডি. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে বড় পরিমাণ ভুতুড়ে ঋণ বিতরণের অভিযোগ রয়েছে। এটা অব্যাহত থাকলে, ব্যাংক খাত সংকটে পড়বে। অনুপাতের বাইরে ঋণ বিতরণ করলে ঋণ ব্যবস্থাটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ের চিত্র সন্তোষজনক নয়। অতিরিক্ত ঋণ বিতরণের পাশাপাশি যদি খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়তে থাকে, তাহলে সেই ব্যাংক বিপদে পড়বে এবং আমানতকারীদের ভুগতে হবে। ঋণ অনুপাত লঙ্ঘনকারী ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরুরি হস্তক্ষেপের পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের এডিআর বা ঋণ-আমানত অনুপাত ৯৮ দশমিক ২৩ শতাংশ ছুঁয়েছে। একইভাবে এবি ব্যাংকের প্রথাগত ব্যাংকিং শাখায় এডিআর ৯৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ ও শরীয়াহ ব্যাংকিং শাখায় এডিআর ১০৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ব বেসিক ব্যাংকে এডিআর ৯১ দশমিক ১৭ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকে ৮৯ শতাংশ, বহুজাতিক ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে ৮৭ দশমিক ৫২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এসব ব্যাংকে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, কমিউনিটি ব্যাংকে এডিআর এখন ৮৮ দশমিক ২৮ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংকে ৮৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকে ৮৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। শরীয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকে এডিআর হয়েছে ১০০ দশমিক ২৮ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ৯৬ দশমিক ২৮ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং শাখায় ১৫৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং শাখায় এডিআর এখন ১৩৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। শরীয়াহভিত্তিক আরও পাঁচটি ব্যাংকের এডিআর এখন ৯৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ থেকে ১০৪ দশমিক ৫৪ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।

এ বিষয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ইউএনবিকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চিতভাবেই পর্যাপ্ত গবেষণা ও বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঋণের সীমা নির্ধারণ করেছে। কোনো ব্যাংকেরই উচিত নয় এই সীমা লঙ্ঘন করা। ঋণ-আমানত অনুপাত লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ব্যাংক খাতে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এরইমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকগুলোর এডিআর সীমা লঙ্ঘন দেখতে পেলে স্বাভাবিক অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক তাদেরকে সীমার ভেতরে ফিরে আসতে সময় দিয়ে থাকে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে সীমার বাইরে থাকলে তাদেরকে সতর্ক করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।