কতক বুদ্ধিজীবীর প্রকৃত সন্ধানে

আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২

মাওলানা ওমর আলী

১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাসার খুব কাছেই বুদ্ধিজীবী শহীদ মিনার হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই এর সাথে নিবিড় সম্পর্ক।তথন শহীদ মিনার ছিলো প্রকৃত বেদনার এক মিনার। ইট পাথরের এমন আড়ম্বরতা ছিলোনা। ছিলো ছায়াঢাকা তালগাছের সারির ফাঁকে এক বেদনাময় স্মৃতিচিহ্ন। এখানে আসলে অজানা শহীদদের জন্য একবুক ব্যথা অনুভূত হতো। এক চাপা কষ্ট পুরো এলাকা জুড়ে বিরাজ করতো। বিজয় দিবসের মতো ১৪ ডিসেম্বরও ছিলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে মেধাশুন্য জাতিতে পরিণত করার নীল নকশার অংশ হিসেবে বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা ছিলো ইতিহাসের এক কাপুরুষোচিত পৈশাচিক হত্যাকান্ড। 

স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে না পারা আমাদের জন্য এক চরম ব্যর্থতা। হত্যাকারীরা  তখনো দানব ছিলো, এখনো তাই।

আমাদের আরেকটি বড়ো ব্যর্থতা হলো, স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির বুদ্ধিজীবীদের সাথে পাকিস্তানের সেবাদাস বুদ্ধিজীবীদের গুলিয়ে ফেলা। স্বাধীনতাউত্তর কোলকাতাকেন্দ্রিক সুশীল সমাজ এ দেশের জনগণকে এমন কিছু বুদ্ধিজীবীকে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত করে তুলেছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ই পাকিস্তানের গুণগান করে গেছেন, তাদের থেকে নিয়মিত মাসোহারা থেকে শুরু করে  অন্যান্য সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন। এরমধ্যে অন্যতম হলো চৌধুরী সহোদর-কবির চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী। বাংলাদেশের প্রধান কবি বলে পরিচিত সামছুর রহমানও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কম খেদমত করেননি। পাকিস্তান সরকারের মালিকানাধীন ” পাকিস্তান টাইমস” পত্রিকার সম্পাদকের মহাদায়িত্ব পালন করেছেন। গণেশ উল্টে গেলে যেন কোনোরুপ ঝামেলায় না পড়ে সে জন্য ” স্বাধীনতার  কবিতাও লিখেছেন। কবিতাখানি আদীব মাযলুম ছদ্বনামে লিখেছেন যাতে পাকিস্তান সরকারের কৃপার দৃষ্টি সরে না যায়। অথচ তিনি অন্যকোনো ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করেননি। তাকেও আমরা চিনি স্বাধীনতার বিশাল কবি হিসেবে। আরো চিনি কবি সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমামদেরকেও। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে জনগন স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির বুদ্ধিজীবী হিসেবে জানে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিলো। একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। তারা প্রাণপণে দেখানোর চেষ্টা করেছিলো-দেশের অবস্থা স্বাভাবিক আছে। শুধু কতিপয় দুষ্কৃতি দেশে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছে। বিনিময়ে তারা পেতো পাকিস্তান সরকারের বিশেষ ইনাম আর আর অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। আমরা যাদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে জানি তারা মাঝে মধ্যে পাকিস্তান সরকার পক্ষে বিবৃতিও দিতো। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর একটি কথা স্মর্তব্য –

“দেশে যুদ্ধ চলছে, তুমুল যুদ্ধ। পাকিস্তানিদের পক্ষে ঢাকার ৩১ বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি বের হয়েছে। এক নম্বরে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী আর একত্রিশ নম্বরে কবি তালিম হোসেন। কবীর চৌধুরী বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক।” (তথ্যসূত্র,কাদের সিদ্দিকী, দৈনিক আমার দেশ।২৭/৯/১১।)

কবি সুফিয়া কামাল জিন্নাহকে নিয়ে ০৮ কবিতা লিখে ভালোই আছে। জাহানারা ইমাম ও তার স্বামী শরীফের সরকারি চাকরি বহাল আছে। জাফর ইকবাল যাত্রাবাড়ীর কাছে এক গর্তে বসবাস করছে। 

মাঠঘাট থেকে উঠে আসা অশিক্ষিত সাধারণ মানুষেরা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করছে। শিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশ কাকের সাবান রাখার মতো ঢাকায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে। অন্য অংশ কলকাতায় লুটপাট করে যাচ্ছে। 

১৬ ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন দেশে প্রথম গ্রেফতার হলো ০৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল। জীবন বাজী রেখে নয় মাস যুদ্ধ করার পুরস্কার। আহ! 

“দালাল আইনে গ্রেফতার হলো কবি তালিম হোসেন। পাকিস্তানিদের পক্ষে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি দেওয়া তালিকার এক নম্বরে থাকা মুনীর চৌধুরী হলেন শহীদ আর একত্রিশ নম্বরে থাকা তালিম হোসেন হলেন দালাল।  কবি খুব দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বললেন, ” আমরা একসঙ্গে যারা পাকিস্তানের গোলামী করলাম, বেতন নিলাম তাদের কেউ কেউ মরে শহীদ হলো আমরা বেঁচে থেকে দালাল হলাম”।(বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, দৈনিক আমার দেশ,২৭/৯/১১)

১৪ই ডিসেম্বর মারা যাওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীরাও পাকিস্তানের সরকারের কাছ থেকে নভেম্বর মাসের বেতন নিয়েছে। 

তারপর, তারপর আর কি?

দেরাদুন, কলকাতা, গৌহাটি, বালিগঞ্জ আর ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা মিলেমিশে একাকার হলো। বুদ্ধিজীবীরা এবার চেতনার ব্যবসা শুরু করলো। সারাদিন তারা মুক্তিযুদ্ধ ফেরী করে বেড়ায়। জহির রায়হান চেতনার  ব্যবসা না বুঝে অফসাইডে গোল খেয়ে গেল।”

অপরদিকে যুদ্ধ না করে যারা কোলকাতা পালিয়ে গিয়েছিলেন, হয়েছিলেন কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী তাদের আংশিক পরিচয় দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর কবির তার “ধীরে বহে মেঘনা”য় তুলে ধরেছেন। আমাদের দেশের বর্তমান তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাও সে ধারায়ই চলমান।

আহমদ ছফা বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে বলেছিলেন, ” বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।’ বুদ্ধিজীবীরা সত্যা-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দের নিরিখে কখনো ভূমিকা পালন করেন না। তারা মূলত সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন, সমাজের কল্যাণসাধনের জন্য নয়, নিজেদের আখের গোছাতে। ফলে তারা যখন কোনো পক্ষাবলম্বন করেন, তখন যেমন তাদের কোনো পূর্বপরিকল্পনা থাকে না, তেমনি পক্ষত্যাগকালেও থাকে না। তথ্যসূত্র;বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাস,আহমদ ছফা।ছফার মতে, ‘আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়—প্রয়োজনে।

হিটলার ৬০ লক্ষ ইহু-দী হ-ত্যার পর রেখে যাওয়া বাকীদের দেখে পৃথিবী ইহু- দিদের চিনেছে।

 ১৪ ই ডিসেম্বর বেঁচে যাওয়া বাংলার বুদ্ধিজীবীদের দেখে আমরা আমাদের  তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের চিনেছি, বুঝেছি ভবিষ্যতে আরও বুঝব। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এ সকল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কেই বলেছেন- ” বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে। বুদ্ধিজীবীদের রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ।

একটি প্রশ্ন রেখে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের লেখা শেষ করতে চাই, যে প্রশ্ন আজো ঘুরপাক খায়। স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারী  বুদ্ধিজীবী জহীর রায়হান  কিভাবে শহীদ হোন?