কোথাও সুখবর নেই : আর্থিক খাতের সবই চলছে জোড়া-তালি দিয়ে

পয়গাম ডেস্ক : আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২২

জীবন চলছে কিন্তু প্রাণহীনভাবে। সবকিছুই চলছে; কিন্তু স্বাভাবিকতা নেই। সংসার জীবনে টিকে থাকার লড়াইয়ে খাবার ও অন্যান্য খরচ কমিয়ে দিয়ে মানুষ বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। চেখে দেখলে মনে হয় সবকিছুই ভালোভাবে চলছে। কিন্তু বাস্তবে সবই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। ডলার সঙ্কট, ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা, রেমিট্যান্সের প্রবাহে ভাটা, গার্মেন্ট পণ্যের ক্রেতা কমে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটে গার্মেন্টস ও শিল্পকারখানা উৎপাদন কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া চলমান অর্থনীতির সব সূচকই অস্বাভাবিক, অগ্রগতি নেই। উন্নয়ন ও উৎপাদনের কথামালার প্রচারণা দৃশ্যমান থাকলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলার সঙ্কট, জ্বালানি সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি, খাদ্যসহ সব সঙ্কটই আরো ঘনীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো দেখা গেলেও অধিকাংশ সূচকই অস্বস্তিতে। এর মধ্যে অন্যতম মুদ্রাস্ফীতি। কাগজে-কলমে এখনো দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে, ৬ শতাংশের একটু বেশি। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্তের এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

দেশের অর্থনীতির চিত্র নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ বলেছেন, আমাদের অর্থনীতি ভালো নেই। সব দিক থেকেই। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মূল্যস্ফীতির শিকার। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের যে সামান্য সঞ্চয় ছিল, সেই সঞ্চয় এখন তারা বেঁচে থাকার জন্য ভেঙে ভেঙে খাচ্ছেন। একদিকে অর্থনীতি এগোচ্ছে না বা উৎপাদনশীল হচ্ছে না। অর্থনীতি এগোচ্ছে না মানে হচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধি বা প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। মানুষও বেকার হচ্ছে। অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে বা তাদের শ্রমিকদের ছাঁটাই করছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা এত সহজ নয়। মহামারি করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা করলেও বিপাকে ফেলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যার নেতিবাচকপ্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। দেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো করলেও অধিকাংশ সূচকই নিম্নমুখী বা স্বস্তিকর অবস্থায় নেই। ডলার সঙ্কটে এখনো আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক হয়নি। এর মধ্যে রফতানি আয়ের প্রধান উৎস অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রতিদিনই কমছে। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এছাড়া ডলার সঙ্কটের কারণে নিত্যপণ্যের এলসিও খোলা যাচ্ছে না। এমনকি প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ বিপর্যস্ত প্রায় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক এমনটিই মতো আর্থিক খাতের গবেষকদের। আর্থিক খাতের মন্দায় দেশের খাদ্য, জ্বালানি ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার পাশাপাশি সঙ্কটে ফেলেছে কৃষি উৎপাদনকে এবং সংকুচিত হচ্ছে মানুষের কাজের ক্ষেত্র। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপেও এমন আশঙ্কার তথ্য ব্যক্ত করেছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থা ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন বলছে, দুর্ভিক্ষ আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে বন্যা ও খরা বাড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ডলার সঙ্কট, জ্বালানির উচ্চমূল্য, মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ ও করোনা পরিস্থিতি দেশ ও মানুষকে বিপাকে ফেলছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, বাংলাদেশে খাদ্যের দাম দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছে, বিশ্বে দুর্ভিক্ষ আসছে। কাজেই স্পষ্টতই বাংলাদেশেও এর প্রভাব থাকবে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এরই মধ্যে দেশের মানুষ খাবার গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে। অবশ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিপিডি কিছু সুপারিশ দিয়েছে। এতে সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্যের আমদানিতে কর রেয়াত দেয়া, বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট ভাঙা, ন্যূনতম বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ, উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে সারে ভর্তুকি প্রদান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলেছে সিপিডি। যদিও সরকারের দায়িত্বশীলরা এ নিয়ে চিন্তিত নয়; তাদের মতে, উন্নয়ন মহাসড়কে দেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা চলছে তা সহসাই কাটবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। সঙ্কট উত্তরণে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপের কথা বললেও বাস্তবেই কোন পদক্ষেপই নেই। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে শঙ্কা বাড়াচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।

আর্থিকখাতের সঙ্কট নিয়ে সম্প্রতি সিপিডি ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ উত্তরণ কোন পথে?’ শীর্ষক ব্রিফিংয়ে সঙ্কট উত্তরণের নানা দিক তুলে ধরেছে। সিপিডির মতে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ সাত ধরনের সঙ্কটে পড়েছে। সেগুলো হলো ডলার সঙ্কট, জ্বালানি সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি, খাদ্য সঙ্কট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কট। সঙ্কটের মধ্যে ডলার, জ্বালানি, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সঙ্কটের কারণে অন্য সঙ্কটগুলো আরো ঘনীভূত হচ্ছে। কাজেই এই সাত সঙ্কট বাংলাদেশের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে সিপিডি। এরআগে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে পৌঁছার আশঙ্কা করা হয়। মধ্যমেয়াদি অর্থনৈতিক সঙ্কটে রয়েছে বাংলাদেশ, যা আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূলত তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সবকিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে; সরকার অবশ্য সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে এ বছর চালের উৎপাদন কম হয়েছে; বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমনের চাষ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। তাই সামনে কঠিন পরিস্তিতির মুখে পড়তে হচ্ছে দেশকে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো করলেও সব সূচকই স্বস্তিকর অবস্থায় নেই। এর মধ্যে অন্যতম মুদ্রাস্ফীতি। কাগজে-কলমে এখনো দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে, ৬ শতাংশের একটু বেশি। তবে বাজারদরের প্রতিফলন সরকারি পরিসংখ্যানে নেই। প্রায় সব ধরনের পণ্যের দরই ঊর্ধ্বমুখী। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্তের এখন সংসার চালানোই দায়। এমনকি প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর তাই বিশেষজ্ঞদের ধারণা দেশের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ঘরে।