খতম তারাবীহ্‌—আনন্দময় এক ইবাদাত 

তারাবীহ্‌র নামায নিয়ে আমার বিবিধ অভিজ্ঞতা আছে। আর দশ জনের সাথে ঐগুলোকে শেয়ার করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। আমি নিজেও অন্যের অভিজ্ঞতা খুব যত্নের সাথে শ্রবন করি। আমি বিশ্বাস করি, একজনের অভিজ্ঞতার যথার্থ বিশ্লেষণ অন্যজনকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।   

।। ১ ।।  

১৯৭৪ সাল। বয়স তখন মাত্র বার। 

থাকি চট্টগ্রামের হালিশহরে। সাগর পাড়ের অসাধারণ সুন্দর একটি এলাকা। 

শবে-বরাতের  ক’দিন পরের ঘটনা। মসজিদে মহল্লার মুসুল্লিরা বৈঠকে বসেছেন। বিষয়ঃ একজন হাফেয সাহেব খোঁজা হচ্ছে তারাবীহর নামায পড়ানর জন্য। কৌতূহলের কারণে বসে পড়লাম। কিন্তু কয়েক মিনিট পড়েই উঠে গেলাম। কারণ, কোন কিছু ঠিকমত  বোধগম্য হচ্ছে না। তারাবীহ কি ? তখন পর্যন্ত কোনদিন পড়িনি, এমন কি কোথাও খতম-তারাবীহ হতেও দেখিনি। আর হাফেজ সাহেবেরই বা দরকারটা কি ? মসজিদে ইমাম সাহেব তো  আছেন। তাহলে উনাকে কি বাদ দেয়া হবে ? শুনলাম তা-ও না। 

বাসায় এসে আম্মাকে সব বললাম। আম্মা বললেন, “রমাযান মাসে এশার ২ রাকাত সুন্নাতের পর বিত্ রের  আগে দুই দুই রাকাত করে ২০ রাকাত অতিরিক্ত নামায পড়তে হয়। এটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ । এটাকে তারাবীহ র নামায বলে। এই নামাজে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করতে হয়। এজন্য হাফেজ সাহেব দরকার।”   

আম্মার কথা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। ভীমড়ি খাওয়ার দশা। বলেই ফেললাম, “ও-রে বাবা-রে! এটা কেমনে সম্ভব ! তাহলে ঘুমাবে কোন সময় ? সেহরি খাবে কোন সময় ?” আসলে আমি ভাবছি প্রতিদিনই বুঝি ২০ রাকাতে একবার করে কুরআন খতম করতে হবে। আম্মা বুঝতে পারলেন। বুঝিয়ে দিলেন যে, প্রতিদিন নয়, গোটা মাস লাগিয়ে কুরআন শরীফ একবার মাত্র খতম করতে হবে। 

দেখতে দেখতে ১লা রমাযান এল। একজন হাফেয সাহেব যোগাড় হয়েছে। তবে তিনি না কী মাত্র ২২ পারার হাফেয ! সুতরাং তিনি  কী ভাবে সম্পূর্ণ  কুরআন খতম করবেন, সেটা নিয়ে  সমবয়সীরা বিস্তর গবেষণা শুরু করেছি। যাহোক, তারাবীহ শুরু হল। দেখতে দেখতে ১৬/১৭  তারাবীহ শেষ হল। হাফেয সাহেবের ২২ পারাও শেষ। এবার কি হবে ?

পরের দিন সকাল বেলা হাফেয সাহেবের ওস্তাদ এসে হাজির। এতদিনে বুঝলাম যে,  উনি বাকী ৮ পারা পড়ে শেষ করে দেবেন।

ঐ রাতে মসজিদে ভিড় বেড়ে গেল। হাফেয সাহেবের ওস্তাদ নামায পড়াবেন! সব্বাইর আগ্রহই একটু বেশী। কেমন জানি পড়ান !  

বাদ সুন্নাত তারাবীহ শুরু হল। ওস্তাদ হাফেয সাহেব তিলওয়াত শুরু করলেন । তিলওয়াত-ও  বেশ চমৎকার। কিন্তু রুকুতে যাওয়ার কোন আভাষ যে  নেই। হাফেয  সাহেব পড়েই চলেছেন, পড়েই চলেছেন। অন্যান্য  দিনের চেয়ে দ্বিগুণের ও বেশী সময় পরে  রুকুতে গেলেন। একই অবস্থা হল দ্বিতীয় রাকাতের ক্ষেত্রেও। এভাবেই পড়া হল বিশটি রাকাত। নামায শেষ হল প্রায় মাঝরাতে।  

বিতর, মুনাজাত ইত্যাদির পর মুরুব্বীরা মিলিত হলেন হাফেয সাহেবের সাথে ; সাথে আমরা অনেকে, কৌতূহল দমন করতে না পেরে।   

: হুজুর, আজ অনেক লম্বা নামায পড়লাম। কতটুকু পড়েছেন ? একজন বেশ সম্ভ্রমের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন। 

: আজ পড়েছি মাত্র সারে তিন পারা। হাফেয সাহেব বেশ সহজভাবেই বললেন।   

: রোযার তো এখনও অনেক বাকি। তাহলে আজ এত বেশী পড়লেন কি মনে করে ?  

: কারণ হচ্ছে ২২,২৩,২৪,২৫ পারা পর্যন্ত মুখস্থ করেছে এমন ৪ ছাত্রকে ৪ জায়গাতে দিয়েছি। কি করব, বলুন ? হাফেজ তো  নেই। গত ২-৩ বৎসর যাবত মাদ্রাসাগুলো যে  দুরবস্থায় আছে, আগামীতে হাফেয-মাওলানা তৈরি হবে কি না ঢের সন্দেহ আছে। তো আমাকে উক্ত ৪ স্থানে গিয়েই খতম পূর্ণ করতে হবে। সে হিসাবে আজ সারে তিন পারা পড়লাম। কালকে আবার সারে তিন পারা পড়ব। পরশু এক পারা পড়ে খতম দিয়ে দেব।

মুরুব্বীরা মুখ চাওয়া-চাহি করছেন। তারা এমন কিছু শুনার জন্য অবশ্যই প্রস্তুত ছিলেন না।  শেষ-মেশ মুখ খুললেন তিনি, যিনি সবচে’ বয়োবৃদ্ধ। 

: হাফেয সাহেব, আমরা তো এত লম্বা সময় নামায পড়তে অভ্যস্ত নই। দুটো দিন সময় কি বাড়ানো যায় না ? 

দ্বিধায় পড়ে গেলেন হাফেয সাহেব। একদিকে বাবার বয়সী একজন বুড়ো মানুষ অনুরোধ করছেন, অন্যদিকে নিশ্চয় নিজস্ব একটা হিসাব কষা আছে। তখন তো আর আজকের মত মোবাইলের যুগ ছিল না,  যে তাৎক্ষণিক ভাবে পরিবর্তিত প্লান অন্য কাউকে জানিয়ে দেয়া সম্ভব। দীর্ঘক্ষণ চিন্তার পর বললেন, “একদিন বাড়াতে পারি। এর চেয়ে বেশী কিছুতেই সম্ভব  নয়। আমাকে মাফ করবেন।”  

: বহুত মেহেরবানী। প্রায় সবাই একযোগে বলে উঠলেন। 

সে মতে আরো দুদিনের স্থলে  ৩ দিনে হাফেয সাহেব খতম করলেন । এই ৩ দিনের প্রথম দিনে ২ পারা, দ্বিতীয় দিনে দেড় পারা এবং তৃতীয় দিনে ১ পারা পড়লেন।  বহু বৎসর আগের ঘটনা। কিন্তু স্মৃতিতে আজো অম্লান। সাধারণতঃ জীবনের “প্রতিটি প্রথম”-ই আমরণ মানুষের মনে থাকে। তার ওপরে যদি এত মজাদার হয়ে থাকে তবে তো কোন কথাই নেই। 

পাঠকদের আনন্দ দেয়া ছাড়াও ভিন্ন একটি কারণে ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। সেটি অবশ্য  আরো অনেক অনেক বেশী আনন্দের।  আজ যখন আশেপাশে অনেক  হাফেয  সাহেব দেখি, মনটা অনাবিল আনন্দে ভরে ওঠে। পরম করুণাময়ের নিকট শুকরিয়া আদায় করি এই ভেবে যে, ঐ ওস্তাদ হাফেয সাহেবের আশঙ্কা কিংবা দুর্ভাবনা বাস্তবায়িত হয় নি। বর্তমানে অনেকের কাছে ঐ ওস্তাদ হাফেজ সাহেবের আশঙ্কা ভিত্তিহীন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ১৯৭২-১৯৭৫ যাদের খুব ভালভাবে মনে আছে, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে বুঝা যায় যে ঐ আশঙ্কা মোটেও অমূলক ছিল না। তেমন একটি দুঃসময় যেন এই জাতির জীবনে আর না আসে, সেই কামনা ও প্রচেষ্টা অহর্নিশি আমাদের সকলের সকলের থাকা উচিত।  

।। ২ ।। 

একই স্থান, একই মসজিদ। তবে সময়টা আরো ২-৩ বৎসর পরে।

এবার তারাবীহ পড়াতে এসেছেন ২ জন । ২ জনই পূর্ণ হাফেয, বাড়ি সন্দ্বীপ। 

উঁহু ! এ এক ভিন্ন  তারাবীহ। পরবর্তী জীবনে কক্ষনো তেমন ধারার তারাবীহ পড়ি নাই। এ ছিল এক আজীব প্রতিযোগিতা ! কে কত দ্রুত পড়তে পারে !!  

হাফেয সাহেবদ্বয়ের  প্রত্যেকে ১০ পৃষ্ঠা করে তিলাওয়াত করতেন। একজন তার অংশটুকু ২০ মিনিটে শেষ করলে, অন্যজন তার অংশটুকু শেষ করতেন ১৮ মিনিটে। এবার ১ম জন পরের দিন সময় লাগাতেন ১৭ মিনিট। ২য় জন তখন আপ্রাণ চেষ্টা করতেন ১৭ মিনিটের কম লাগাতে। এমন ধারা প্রতিদিন চলত। মুসুল্লীরা বেজায় খুশী। তারাবীহ চট্‌ করে শেষ হয়ে যেত।  কিন্তু আসলে যে এর দ্বারা তারাবীহ্‌র বারোটা বাজান হত, সেটি অনেক পরে বুঝেছি। কারণ তারাবীহ্‌ উদ্দেশ্যই হল আরামের সাথে ধীরে সুস্থে পড়া। দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে,  এক সময়ে, কত দ্রুত তারাবীহ্‌ পড়া যায়, এমন একটা অসুস্থ মানসিকতা গোটা দেশে ছেয়ে গিয়েছিল। মহান আল্লাহ্‌র শুকরিয়া এটা বর্তমানে অনেক কমে এসেছে।    

।। ৩ ।। 

সেই একই মসজিদে পরবর্তী রমজানের তারাবীহ্‌। 

এবার তারাবীহ্‌র ইমাম হাফেয আব্দুল করীম সাহেব। বয়স ৫০-৫৫ এর ঘরে। উনাকে কয়েক মাস আগে স্থায়ী ইমাম হিসাবে নিয়োগদান করা হয়েছে। হুজুরের তারাবীহ্‌ পড়ানোর মধ্যে ৩ টি ব্যতিক্রমী বিষয় ছিল।  প্রথমতঃ হুজুর প্রতিদিন সোয়া (৫/৪) পারা করে পড়তেন (যেহেতু মুসুল্লীরা অনুরোধ করেছিল ২৫ রমজানে খতম করার জন্য।)   দ্বিতীয়তঃ এই সোয়া পারার ১ পারা তিনি ১ম ৪ রাকাতে পরে ফেলতেন। আর অবশিষ্ট ১/৪ অংশ শেষ করতেন বাকি ১৬ রাকাতে। এই অদ্ভুত স্টাইলের জন্য একদিন উনাকে প্রশ্ন করা হল। তিনি ভেঙে বললেন, “আমার বয়স ৫৩ ; বেশ কিছুক্ষণ পর দম চলে যায়, গলাও বসে যায়। তাই শক্তি থাকতে থাকতে যতটুকু পারি পড়ে নেই।”  

তৃতীয়তঃ হুজুর বেশ ধীর লয়ে পড়তেন। যে কোন আনাড়িও বুঝতে পারত, হুযুর কোথাও আটকাচ্ছেন না। একই গতিতে সাবলীলভাবে পড়ে যাচ্ছেন! (আজ, এত বৎসর পর বুঝতে পারছি যে, হুযুরের গলাটা যদি আর একটু মানসম্মত হত তাহলে সারাদেশে উনার নাম ছড়িয়ে পড়ত)। অথচ, হুযুরকে দিনের বেলা দাওর করতেও দেখতাম না (যেমন তারাবীহ্‌র হাফেযদেরকে আমরা দেখি দিনের বেলা আসছে রাতের পাঠ্য অংশটুকু বারংবার পড়তে, যাতে তারাবীহ্‌র সময় ভুল না হয় কিম্বা বেঝে না যায়।) যাহোক, টুকটাক খেদমত করতাম বলে হুযুর আমাকে খুব আদর করতেন। তাই সাহস করে  একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, হুজুর! আপনার সাথে আর কেউ নেই। যদি ভুলে হয়ে যায় কিম্বা প্যাঁচ লাগে অথবা বাদ দিয়ে যান, তাহলে বুঝবেন কি করে ? হুজুর যে জবাব দিয়েছিলেন, আজো তা আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, বাবা! যেদিন হাফেয হওয়ার পাগড়ী নেই, সেদিন আমার উস্তাদ আমাকে নসিহত করেছিলেন, “আব্দুল করীম! কথা দাও, প্রতিদিন ১ মঞ্জিল করে পড়বে। এতে ৭ দিনে ১ খতম হবে।” আমি আমার ওস্তাদকে কথা দিয়েছিলাম। আল্লাহ্‌র লক্ষ-কোটি শুকরিয়া আজ ৩৫ বৎসর হতে চলল, এর মধ্যে এমন কোন সপ্তাহ পার হয়নি, যে সপ্তাহে আমার এই আমল ছুটে গেছে। এর উসিলায়, আল্লাহ্‌র রহমতের উপর আমার বিশ্বাস আছে যে, আমার কোন ধরণের সমস্যা হবে না।” দুঃখের বিষয়, এমন একজন অসাধারণ হুজুর আড়াই বৎসর পর চাকুরী ছেড়ে নিজ বাড়িতে (চাঁদপুর জেলার শাহ্‌রাস্তি উপজেলা) চলে যান। কারণ, মসজিদ কমিটির লোকেরা জিগীর তুলল, হুযুরের সুর দিয়ে ওয়াজ করতে পারেন না। 

।। ৪ ।। 

এবারের কারগুজারী হাফেয আব্দুল হক সাহেবকে নিয়ে। নামেই যার পরিচয়!  এদেশে অনেক আব্দুল হামীদ আছে। তবে আব্দুল হামীদ বললে, প্রথমেই মনে পড়বে রাষ্ট্রপতির কথা। ঠিক তেমনি ! আব্দুল হক তো অনেক! এমনকি হাফেয আব্দুল হকও কম নয়। তথাপি কারীসাহেব এবং হাফেয সাহেবগণের জগতে আব্দুল হক নামটি উচ্চারণ করলে বিশেষ একজনকেই মানুষ চিনে। যার ছাত্র হতে পাওয়া পড়ুয়াদের কাছে রূপকথার মত। যার পেছনে নামায আদায় করা একজন মুসুল্লীর জন্য স্বপ্নের বিষয়।  আলহামদুলিল্লাহ্‌ ! আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যে ২ বৎসর উনার ইমামতিতে তারাবীহ্‌ আদায় করেছি।  ১৯৮৩-৮৪ অথবা ৮৪-৮৫ সালের কথা। ঢাকার মহাখালী রেলক্রসিং সংলগ্ন বাইতুল মাহফুজ জামে মসজিদ। মসজিদটি তখন টিন-শেডের, সাথে ছিল ১টি হেফজখানা। মসজিদের খতীব ছিলেন মরহুম মাওলানা আব্দুর রশীদ সাহেব। আত্মীয়তা সূত্রে তিনি এক প্রকার জোর করেই নিয়ে আসলেন হাফেয আব্দুল হক সাহেবকে, ন্যস্ত করলেন হেফজখানার দায়িত্ব। হাফেয সাহেব তখন এত মশহুর হননি। আর এটাই ছিল এলাকাবাসীর সৌভাগ্যের উসীলা। [আমি তখন ঐ এলাকায় বাস করতাম। আমার বাসা থেকে মসজিদে হেঁটে যেতে খুব বেশী হলে ২ মিনিট লাগত।]

রমাযানের প্রাক্কালে মসজিদ কমিটি স্থির করল, যেহেতু মসজিদ ভিত্তিক হেফজখানা, তাই হেফজখানার প্রধান ওস্তাদ আব্দুল হক সাহেব এবং অন্য একজন ওস্তাদ, এই ২ জনে মিলে খতম-তারাবীহ্‌ পড়াবে।     ১লা রমযানের রাত। ঈশার ফরয-সুন্নতের পর মুসুল্লিরা তারাবীহ্‌র জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। হাফেয আব্দুল হক সাহেব নিয়ত বাঁধলেন। উনার ‘তাকবীর-তাহ্‌রীমার’ উচ্চারণ শুনেই মুসুল্লিদের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। এমন জলদগম্ভীর স্বরে “আল্লাহু আকবার” বলতে যে কেউ কোনদিন শুনে নাই। তারপর শুরু হল কুরআন তিলাওয়াত। আমি ভাগ্যবান, আমি শুনেছি। কিন্তু আমি অক্ষম, আমি লিখে বা বলে সেই তিলাওয়াতের মাহাত্ম্য অন্যকে বুঝাতে পারব না।     কণ্ঠস্বর যেমন ভরাট, তেমন মিষ্টি আর পরিষ্কার। প্রতিটি হরফ স্পষ্টভাবে ধরা যায়। আর সুর! সেতো হৃদয়ছোঁয়া !! মনে হত আসমান হতে যেন সরাসরি কুরআন নাযেল হচ্ছে। ফলাফল যা হবার, তাই হল। অর্থাৎ ‘ভিনি-ভিডি-ভিসি’ — এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। স্মার্টফোন ছিল না, তাই ভাইরাল হয়নি। কিন্তু যেটা হল সেটা ভাইরাল থেকেও বেশী। নামায শেষে সমবেত মুসুল্লিদের একটাই মন্তব্য, “তারাবীহ্‌তে এমন মজার তিলাওয়াত ইহজীবনে শুনি নাই।” যারা পথিক, দূরের যাত্রী, আফসোসের স্বরে বলতে লাগলেন, “আহা! দূরে চলে যাচ্ছি। এই পড়া তো আর পাবো না।” চাক্ষুষ ফলাফল পেলাম পরের রাতের তারাবীহ্‌তে। মুসুল্লির সংখ্যা বেড়ে গেল। তার পরের রাতে আরও বাড়ল। অনেক আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা আছে, আশেপাশের ঐ সমস্ত মসজিদের অনেক মুসুল্লি ভাঙাচোরা, অসম্পূর্ণ রেলগেট মসজিদে এসে তারাবীহ্‌তে শরীক হতে লাগলেন।  তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। মসজিদে এসি তো দূরের কথা, পর্যাপ্ত সংখ্যক ফ্যানও ছিল না। মুসুল্লিরা দর্‌ দর্‌ করে ঘামতেন, তারপরেও নিষ্ঠার সাথে পুরো ২০ রাকাত তারাবীহ্‌ আদায় করতেন। কুরআন শুনার যে অনির্বচনীয় আনন্দ, আসলে উহা পেতেই তারা এত কষ্ট করতেন। শ্রোতারা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতেন, কেন কুরআনের তিলাওয়াত শুনে যুগে যুগে পৃথিবীতে বহু লোক পাল্টে গিয়েছিল।  হাফেয আব্দুল হক সাহেবে তারাবীহ্‌ পড়াতেন এক অদ্ভুত নিয়মে। প্রতি ২ রাকাতের ১ম রাকাত তিনি অনেক লম্বা করতেন আর ২য় রাকাত খুব ছোট করতেন (সুরা ফীল/কুরাঈশ এর সমপরিমাণ পড়তেন।)  প্রথা অনুযায়ী পেছনে আরেকজন হাফেয সাহেব দাঁড়াতেন। কিন্তু আব্দুল হক সাহেব তাকে ৬ রাকাতের বেশী কোন রাতে খাটান নি। কারণ মুসুল্লিরা চাইতো পুরো ২০ রাকাতই যেন আব্দুল হক সাহেব পড়ান ! তাছাড়া ২য় জন খুব নার্ভাস থাকতেন। ২ জনের পড়ার মানে এত পার্থক্য যে, দক্ষ হাফেয হওয়া সত্বেও তিনি প্রায় তালগোল পাকিয়ে ফেলতেন। ইমাম সাহেব মাঝে মাঝে ঈশার নামায পড়ানোর জন্য আব্দুল হক সাহেবকে আহবান করতেন। এমনও হয়েছে যে, ঈশার ৪ + তারাবীহ্‌র ২০ + বিতরের ৩ = সর্বমোট ২৭ রাকাত নামাজই আব্দুল হক সাহেব পড়িয়েছেন।

যদিও নিবন্ধটি তারাবীহ্‌ নিয়ে, তবুও প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, ইমাম সাহেব এটা বুঝতেন যে মানুষ হাফেয আব্দুল হক সাহেবের পেছনে নামাযে কুরআন তিলাওয়াত শুনতে দিওয়ানা। মুসুল্লিদের এই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে ফজরের নামাযে ইমামতির জন্যও তিনি মাঝে মধ্যে হাফেয সাহেবকে ঠেলে দিতেন। আহ্‌ ! সে আরেক প্রাণমাতানো তিলাওয়াত। যে শুনেছে, সে-ই জানে সে কি ভাগ্যবান! (পাঠক! আমি তর্কে যাব না, কিন্তু যে কথাটি সব সময়ে বলি, সেটি এখানেও লিখছিঃ সুরাঈম কিম্বা সুদাইসির তিলাওয়াত থেকে হাফেয আব্দুল হক সাহেবের তিলাওয়াত উঁচু স্তরের।)               

 ।। ৫ ।। 

১৯৯১ সালের রমাযান মাস। হযরত ফিদায়ে  মিল্লাত সাইয়্যেদ আসাদ মাদানি(রঃ)র সাথে উনার খান্‌কাতে রমাযান মাস কাটানোর সৌভাগ্য হয়। তারাবীহ্‌ পড়া হত মসজিদে রশীদ-এ। ওখানে যে তারাবীহ্‌ পেয়েছি তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের। ঈশা এবং বিতর, এই অংশটুকু বাদ দিয়েও কেবল তারাবীহ্‌র নামাজেই লাগত ২ ঘণ্টার উপরে। প্রতি ৪ রাকাতের পর বেশ লম্বা বিশ্রাম দেয়া হত। এ সময়ে তাড়াহুড়ো না করে যে কেহ প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করতে পারত। তখন কেহ চা, দুধ, শরবত ইত্যাদি পান করত। অনেকে আবার শুয়ে একটু গড়িয়ে নিত।  খান্‌কার দস্তুর ছিল ২৯শে রমাজান রাতে খতম তারাবীহ্‌ শেষ করা। পরে ৩০ তারিখে তারাবীহ্‌ হলে, তখন সূরা তারাবীহ্‌ পড়া হত। ঐ বৎসর খতম তারাবীহ্‌ পড়িয়েছিলেন ফিদায়ে মিল্লাত (রঃ) এর ২য় সন্তান মাওলানা মাস্‌উদ সাহেব।  হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রঃ)  ১৯৯৭ সালে ঢাকার চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসার মসজিদে রমাযানে মাসব্যাপি অবস্থান ও ইতিকাফ করেন। তখন খতম তারাবীহ্‌ পড়িয়েছিলেন হযরতের বড় ছেলে মাওলানা মাহমুদ মাদানি (বর্তমানে জমিয়ত-উলেমা-হিন্দের একাংশের সভাপতি) সাহেব। ২৯শে রমাযান রাতে ১৮তম রাকাতে  তিনি কুরআন শরীফ খতম করেন। অতঃপর ১৯ তম রাকাতে পড়েন সূরা বাকারার শুরু থেকে কিছু অংশ।  আর ২০তম রাকাতে তিলাওয়াত করেন কুরআন পাকের ঐ সকল আয়াতগুলো যেগুলো রব্বানা / আল্লাহুম্মা দিয়ে শুরু হয়েছে। দিলের সবটুকু দরদ ঢেলে পড়া ! সে আকুতি ছুয়ে গেল মুসুল্লিদের হৃদয়কে। উঠল কান্নার রোল। সে কি কান্না ! মনে হচ্ছিল মানুষগুলোকে ধরে কেহ যেন বেদম জোরে পেটাচ্ছে। আসলেও তো তাই। তারা কাঁদছিল আখিরাতের পিট্টির ভয়ে। তারা কাঁদছিল সে পিট্টি যেন মাফ করে দেয়া হয় এই আশায়। সেদিনের সেই ক্রন্দনে যারা শরিক ছিলনা কিংবা ক্রন্দনরত সে লোকগুলোকে যারা দেখেনাই , তারা ছাড়া কেহ বুঝবেনা যে, রবের শাস্তির ভয়ে কিম্বা রহমতের আশায় ক্রন্দনে যে কী স্বাদ।। 

ঃসমাপ্তঃ

লেখকঃ মোহাম্মদ সালেক 

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি , ঢাকা ১২০৭  

ই-মেইল : sparvez@daffodilvarsity.edu.b