চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক ছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনার পর অনেক নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। ওই ছাত্রীর স্বামীর দাবি, বিশেষ পরীক্ষার জন্য অনুমতি না পাওয়ায় হতাশা থেকে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে বিভাগ কর্তৃপক্ষ বলছে, সেই ছাত্রী বিশেষ পরীক্ষার জন্য আবেদন করেননি। তাঁর বিয়ের বিষয়েও জানে না পরিবার। এর মধ্যে একবার গর্ভপাতও করানো হয়েছে।
অন্যদিকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে কীভাবে এবং কারা মরদেহ উদ্ধার করল এ বিষয়ে কারও সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ও হল প্রশাসনের কেউ ছিলেন না। এ ছাড়া ওই কক্ষের দরজা ভেতর থেকে লাগানোও ছিল না। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বললেও পরে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
সব মিলিয়ে আবাসিক হলে ছাত্রীর মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট খুলছে না। তবে এই ঘটনায় ওই ছাত্রীর পরিবার কোনো মামলা বা অভিযোগ করেনি। হাটহাজারী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের হয়েছে।
গতকাল শনিবার বিকেল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের একটি কক্ষে ওড়না প্যাঁচানো ঝুলন্ত অবস্থায় ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে ময়নাতদন্ত শেষে আজ রোববার বিকেলে মরদেহ তাঁর বাড়ি লালমনিরহাট সদরের নায়েকগর হারাটি গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ওই ছাত্রী তৃতীয় সেমিস্টারে ফলাফল ছিল সিজিপিএ ৩ দশমিক ৯০। গত ৯ মার্চ শুরু হয় ৪র্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা। কিন্তু অসুস্থ থাকায় পাঁচটি কোর্সের মধ্যে তিনটির পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে হতাশায় ভুগছিলেন তিনি।
বিয়ের কথা জানত না পরিবার
দুই বছর আগে তেজগাঁও কলেজের অনার্সের ছাত্র মো. কাউসারের সঙ্গে ওই ছাত্রীর বিয়ে হয় বলে জানা যায়। তবে বিষয়টি পরিবারের কেউ জানতেন না। সহপাঠীদের থেকেও বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। মরদেহ উদ্ধারের দিন ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন মো. কাউসার। কাউসার খোঁজাখুঁজি শুরু করার পরই মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়।
চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা, গর্ভপাত
ওই ছাত্রীর স্বামীর বরাত দিয়ে একজন সহকারী প্রক্টর নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ওই শিক্ষার্থী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। গত মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গর্ভপাত করানো হয়। এ জন্য কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। এ কারণেই সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।
স্বামীর দাবি, বিশেষ পরীক্ষার সুযোগ না দেওয়ায় আত্মহত্যা
ওই ছাত্রীর স্বামী গত শনিবার রাতে গণমাধ্যমকে বলেন, বিশেষ পরীক্ষার অনুমতি না পাওয়ায় ওই ছাত্রী হতাশ ছিলেন। সেই হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করেন।
তবে বিভাগ কর্তৃপক্ষ বলছে, সেই ছাত্রী বিশেষ পরীক্ষার জন্য আবেদন করেননি। এমনকি বিশেষ পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে যে সময় লাগে তা এখনো হয়নি। কারণ, যে সেমিস্টারে বিশেষ পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে, সে সেমিস্টারের পরীক্ষা এখনো চলমান।
বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ আতিকুর রহমান আজকের পত্রিকাকে জানান, ওই ছাত্রী চতুর্থ সেমিস্টারে পাঁচটি পরীক্ষার মধ্যে দুটি পরীক্ষা দিয়েছেন। যে পরীক্ষাগুলো দিতে পারেননি সেগুলো পরের ব্যাচের সঙ্গে দেওয়ার সুযোগ আছে। তখনো যদি কোনো সমস্যা হয়, এরপর বিশেষ পরীক্ষার কথা আসবে। এ ছাড়া চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। ভাইভা বাকি আছে। বিশেষ পরীক্ষার কিছু প্রক্রিয়া আছে।
অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ আতিকুর বলেন, ‘ওই ছাত্রী পরীক্ষা দিতে না পেরে বিভাগের দুইজন শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা বিশেষ পরীক্ষার কথা বলেন। সে এর আগে বিশেষ পরীক্ষার বিষয়টি জানতও না। এ ছাড়া বিশেষ পরীক্ষার অনুমতি বিভাগ দেয় না।’
লাশ উদ্ধারের আগের দিন মারধরের অভিযোগ
এ দিকে ওই ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করার আগের দিন ইফতারের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু উদ্যানের সামনে ওই ছাত্রীকে স্বামীর হাতে মারধরের শিকার হতে দেখেছেন কয়েকজন ছাত্র। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক কয়েকটি গ্রুপেও পোস্ট দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন মো. আনোয়ার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শুক্রবার ইফতারের পর বঙ্গবন্ধু উদ্যানের সামনে এই ছেলেটিকে মেয়েটির সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলতে এবং থাপ্পড় দিতে দেখা যায়। মেয়েটি চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। থাপ্পড় দিয়ে দিয়ে বলছিল, “ওষুধ খাবি না কেন? আমাদের দায়ী করতে? তোকে কীভাবে মারতে হবে? গলা টিপে নাকি অন্য কোনোভাবে? ” আমরা ব্যক্তিগত বিষয় ভেবে পাত্তা দিই নাই। পরে টিভিতে এই ছেলের ছবি দেখে নিশ্চিত হই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. নুরুল আজিম সিকদার বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তবে সে অস্বীকার করেছে।’ সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে থাকার কারণে চেক করার সুযোগ হয়নি।’
সহপাঠীদের ভাষ্য
ওই ছাত্রীর কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি খুব মিশুক প্রকৃতির ছিলেন। ক্লাসের সিআরও (প্রতিনিধি) ছিলেন। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করা, গর্ভপাত, পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারা—এসব কারণে হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগে থাকতে পারে। এ কারণে হয়তো এমনটা করেছেন।
ছাত্রীর বড় ভাই আল আমিন সরকার বিপুল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি শুরু থেকে জেনে আসছি ওর পরীক্ষার কারণে ঘটনাটা ঘটেছে। জুনিয়রদের সঙ্গে ক্লাস করতে হবে, এক বছর পিছিয়ে যেতে হবে—এসব কারণে এটা হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে ওর বিয়ের বিষয়টা জানতে পারলাম। স্যারেরা বলতেছে, হলে নাকি গ্যাঞ্জাম হয়েছে। তার স্বামী নাকি রাগারাগি করছে, মনোমালিন্য থেকেও এটা হতে পারে। কিন্তু আমি বিষয়টা জানি না। তাই আমি কোনো অভিযোগ করছি না। আমার বোন যেখানে নাই, অভিযোগ করে কী করব!’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. নূরুল আজিম সিকদার বলেন, ‘ময়নাতদন্ত শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় হাটহাজারী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
মরদেহ উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, ‘ওই সময় আমরা ছিলাম না। আমরা শুনেছি তার স্বামী নাকি অতিথি কক্ষে বসে একটা মেয়েকে বলছিল ওই ছাত্রীকে ডেকে দিতে। ওই মেয়ে ছাত্রীর কক্ষ ঘুরে এসে জানায় কেউ নেই। এরপর আরেকজনকে বলে ডেকে দিতে সেও ঘুরে এসে দেখে কেউ নাই। পরবর্তীতে তৃতীয়জনকে বললে সে এসে বলে ওই ছাত্রী জানালার গ্রিলের সঙ্গে ঝুলে আছে। পরে তারা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ছাত্রীর ভাই বাদী হয়ে একটা অপমৃত্যু মামলা করেছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’