হেফাজতের জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে গ্রেফতারকৃত আলেমদের মুক্তিসহ সাত দফা ঘোষণা

পয়গাম ডেস্ক :

আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ আয়োজিত জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ শনিবার ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ রাজধানীর গুলিস্তানে অবস্থিত কাজী বশীর মিলনায়তনে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আমীরে হেফাজত আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী।

সভাপতির বক্তব্যে আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ. ঘোষিত হেফাজতের ১৩ দফা আন্দোলনে ক্ষমতা কেন্দ্রিক কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. রেখে যাওয়া আমানত এবং আমাদের পূর্বপুরুষ ওলামায়ে দেওবন্দ তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছে এবং চলবে। তবে একজন মু’মিনের কাছে তার জানের চেয়েও ঈমান প্রিয়, অতএব দেশের প্রত্যেকটা মুসলমানই হেফাজতের নেতা কর্মী বা সমর্থক। তাই যখনই ঈমান আকিদার বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের স্বার্থ সংরক্ষণে এবং হেফাজতের ১৩ দফা বাস্তবায়নে ডাক আসবে তখন দল মত নির্বিশেষে, নিজের রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এজন্য সকলের মানসিক প্রস্তুতিও থাকতে হবে।

তিনি বলেন, আজকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ বিশ্বময় যে ফিতনা ফাসাদ শুরু হয়েছে বরং প্রতিনিয়ত যে হারে নতুন নতুন ফিতনার আবির্ভাব হচ্ছে, তাতে সচেতন অভিভাবক মহল প্রত্যেকে তাদের আগামী প্রজন্মের ঈমান-আকিদা ও বিশ্বাস নিয়ে শংকিত। বর্তমানে ব্যক্তি, পরিবার,সমাজ সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করছে, চারিদিকে অশান্তি আর অশান্তি। সবকিছুর মুল কারণ হচ্ছে মানব জাতির কৃতকর্মের ফল।

তিনি আরো বলেন, আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টিকে ভয় করুন, বিশেষ করে মজলুম হাফেজ, আলেমদের চোখের পানিকে ভয় করুন। এসব জুলুম ও নির্যাতনের কারণে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা অবনতীর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এবংদেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

আমীরে হেফাজত বলেন, হযরত ইউসুফ আ.যখন কারাগারে বন্দি ছিলেন তখন ঐদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সর্বশেষ নবী। পৃথিবীতে আর কোন নবী রাসুলের আগমন ঘটবে না, ওলামায়েকেরাম নবী রাসুলের উত্তরসূরী। তাদের বন্দি রেখে দেশে শান্তি এবং স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। দেশের এই ক্রান্তি কালে অশান্তি ও দুরবস্থা থেকে মুক্তি এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষে প্রথমত হেফাজত নেতা কর্মীদের নামে করা সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুন এবং তাদেরকে দ্রুত মুক্তি দিয়ে মজলুমদের কান্না বন্ধ করুন। আসুন, আমরা সকলেই আগামীতে কোন জুলুম অত্যাচার, গোনাহ বা অপরাধ না করার প্রতিজ্ঞা করে আল্লাহর কাছে খালেছ নিয়তে তওবা করি।

প্রধান আলোচকের বক্তব্যে হেফাজত মহাসচিব আল্লামা শায়েখ সাজিদুর রহমান বলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ দেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. দ্বীনি দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য ২০১০ সালে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই হেফাজতের কোনও রাজনৈতিক ভিশন বা মিশন নেই। হেফাজত শাইখুল ইসলামের ১৩ দফা বাস্তবায়নের পক্ষে পূর্বের ন্যায় নিজেদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। ১৩ দফা হেফাজতের ঘোষিত এজেন্ডা। এর বাস্তবায়নের জন্য হেফাজত অতীততেও কাজ করে গেছে, আগামিতেও করবে ইন শা  আল্লাহ।

তিনি বলেন, দীর্ঘ প্রায় দুই বছর যাবত আমাদের অনেক আলেম-ওলামা বন্দী অবস্থায় কারাগারে দুর্বিষহ জীবন-জাপন করছেন। তাদের পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ধ্বংসের মুখে। আলেম-ওলামাদেড় কেউ কেউ কারাগারে গুরুত্বর অসুস্থ অবস্থাতেও রয়েছেন। আমরা মাওলানা মামুনুল হক, মুফতী হারুন ইজহার, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মুফতী সাখাওয়াত হোসাইন রাজী ও মাওলানা নাছিরউদ্দীন মুনিরসহ হেফাজতের সকল নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি চাই। অবিলম্বে তাদের মুক্তি দিতে হবে।

হেফাজত মহাসচিব বলেন, ইতোমধ্যে যারা জামিনে বের হয়েছেন তাদেরকে প্রায় প্রতিদিন কোর্টের দরজার গিয়ে উপস্থিত হতে হচ্ছে। কোন মানুষের পক্ষে এভাবে মামলার হাজিরার নামে হয়রানি বরদাস্ত করা সম্ভব নয়। আমরা দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে ২০১৬ ও ২০২১ সালেরসহ হেফাজত নেতাকর্মীদের নামে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। আলেম-ওলামাদের এভাবে হয়রানি করবেন না। তাদের এসব মামলার বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিন। মামলা চালাতে চালাতে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নিন।

শায়েখ সাজিদুর রহমান বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের শিক্ষানীতি নিয়ে বারবার ষড়যন্ত্র করা হয়। ইতঃপূর্বে ২০১১ ও ২০১৬ সালে শিক্ষানীতি নিয়ে ষড়যন্ত্র হলে শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ.এর বাঁধার মুখে সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। আমরা জানতে পেরেছি সেই ষড়যন্ত্র আবারো শুরু হয়েছে। এবার তারা ধর্মীয় শিক্ষার পরীক্ষাই বাতিল করে দিচ্ছে। এই ষড়যন্ত্র কোনভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। যে বিষয়ে পরীক্ষা থাকবে না সেই বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কিভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে! এটা ধর্মীয় শিক্ষাকে বাদ দেওয়ারই নামান্তর। আমরা এই ষড়যন্ত্র মেনে নিতে পারি না। শাইখুল ইসলামের শিষ্যরা এখনো জীবিত আছেন। আমরা কোনভাবেই এই ধরণের জাতি ধ্বংসকারী সিদ্ধান্তকে মেনে নেব না। আমাদের দাবি অবিলম্বে জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ইসলামবিদ্বেষী লেখাগুলো বাদ দিতে হবে এবং সকল শ্রেণিতে ধর্মীয় শিক্ষার ওপর ১০০ নাম্বারে পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। একই সাথে জাতীয় শিক্ষা কমিশনে ”আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়ার” প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, পৃথিবীর সমস্ত আলেম-ওলামারা একমত যে কাদিয়ানীরা কাফের। দুনিয়ার প্রায় সকল মুসলিম দেশে কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের বাংলাদেশে এটি এখনো করা হয়নি। তাই কাদিয়ানীরা বিনা বাধায় সরলপ্রাণ গরিব মুসলিমদেরকে লোভে ফেলে কাফের বানাচ্ছে। এছাড়াও তারা মুসলিম নাম ধারণ করে সাধারণ মুসলমানদের ধোঁকা দিচ্ছে। এই অবস্থায় অবিলম্বে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে। এটি বাংলাদেশের সকল নবীপ্রেমী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তৌহিদী জনতার প্রাণের দাবি।

হেফাজত মহাসচিব বলেন, দিল্লীর মাওলানা সা’দ সাহেবের বাংলাদেশে আসাকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালে বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। বাংলাদেশের দাওয়াতে তাবলীগের মধ্যে নজিরবিহীন বিভেধ তৈরি হয়েছে। ঘরে ঘরে, মসজিদে মসজিদে ফাসাদ তৈরি হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি এবারও ইজতেমা উপলক্ষে তিনি বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশে আসলে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হবে। শান্ত ও সুন্দর পরিবেশ নস্যাৎ হয়ে যাবে। তাই আমরা দাবি জানাচ্ছি, মাওলানা সা’দ সাহেবকে কোনভাবেই যেন বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া না হয়।

সাত দফা দাবি :

(১) অবিলম্বে হেফাজত নেতাকর্মী ও আলেম-উলামাদের মুক্তি দিতে হবে।

(২) হেফাজত নেতাকর্মীদের নামে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

(৩) ইসলাম ও মহানবী (সা:) সম্পর্কে কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।

(৪) কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে।

(৫) শিক্ষা কারিকুলামে ধর্ম শিক্ষার পরিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

(৬) জাতীয় শিক্ষা কমিশনে হাইয়াতুল উলইয়ার প্রতিনিধি থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

(৭) বিশ্ব ইজতেমায় বিতর্কিত মাওলানা সা’দ সাহেবকে আসার অনুমতি দেওয়া যাবে না।

কর্মসূচী :

(১) স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জেলা-উপজেলা কমিটি গঠন।

(২) দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে শানে রেসালত সম্মেলন।

(৩) রাজধানীতে জাতীয় শানে রেসালাত সম্মেলন।

সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন, সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, নায়েবে আমীর আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুর (পীর সাহেব দেওনা), মাওলানা আব্দুল আওয়াল, মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী, মাওলানা সালাউদ্দিন নানুপুরী, মুফতী জসিম উদ্দিন, মুফতী মোবারক উল্লাহ, মাওলানা মাহফুজুল হক, মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ, মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী, মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম সোবহানী, মাওলানা আনোয়ারুল করীম যশোরী, মুফতী হাবিবু রহমান কাসেমী, মাওলানা শাব্বির আহমদ রশিদ, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, মাওলানা রেজাউল করীম জালালী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, মাওলানা আব্দুল বাসেত খান, মাওলানা শওকত হোসাইন সরকার, মাওলানা মীর ইদরীস নদভী, মুফতী কেফায়েতুল্লাহ আজহারী, মাওলানা জালালুদ্দিন আহমাদ, শায়েখ হারুজ আজিজী নদভী, মাওলানা ইয়াহহিয়া, মাওলানা মাসুদুল করীম,  মুফতী হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমী, মাওলানা ফয়সাল, মাওলানা জুনাইদ বিন ইয়াহিয়া, মাওলানা রাশেদ বিন নূর, সাইয়েদ মাহফুজ খন্দকার, মুফতী ইলিয়াস হামিদী, মাওলানা মুসতাকিম বিল্লাহ হামিদী, মাওলানা গাজী ইয়াকুব উসমানী প্রমুখ।

বার্তাপ্রেরক

মুফতী কেফায়েতুল্লাহ আজহারী

প্রচার সম্পাদক

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ