দাদা ও চাচার তত্বাবধানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম 

বক্ষ বিদারণের ঘটনার পর হযরত হালিমার মনে জাগলো যে, এ শিশুকে কোনরূপ ব্যথা দেয়া চলবে না। কাজেই তিনি তাঁকে সাথে নিয়ে মক্কায় হযরত আমিনার নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং সকল ঘটনা খুলে বললেন। এ সব ঘটনা শুনে হযরত আমিনা খুব একটা বিস্মিত হলেন না; বরং তাঁকে গর্ভধারণ ও প্রসবকালীন সময়ে নূরের আভার সেই ঝলকানি এবং এর কল্যাণ ও বরকতময় যেসব ঘটনা ঘটেছিল, সেসব স্মরণ করে বললেন, আমার এ পুত্রের মর্যাদা খুবই বেশি হবে। জন্ম থেকেই তার প্রতি শয়তানের প্রভাব ও শ্যেনদৃষ্টি পড়েছিল। তুমি নিশ্চিন্ত থাক একে কোন বিপদ স্পর্শ করবে না । হালিমা নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন আর শিশু মুহাম্মদ (সা) নিজ মাতার কাছেই রয়ে গেলেন। যখন তাঁর বয়স ছয় বছর হযরত আমিনা তাঁকে সাথে নিয়ে মদীনা গমন করলেন। উম্মে আয়মানও তাঁদের সহযাত্রী ছিলেন। এক মাস তাঁরা নিজ আত্মীয়-স্বজনের সাথে মদীনায় অবস্থান করলেন। এরপর মক্কার পথে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে হযরত আমিনা ইনতিকাল করলেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।

আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে

উম্মে আয়মান তাঁকে নিয়ে মক্কায় ফিরে এলেন এবং তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিবের নিকট সোপর্দ করলেন। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে সব সময় সঙ্গে রাখতেন। তিনি যখন কাবাগৃহে গমন করতেন, কাবার ছায়ায় তার জন্য মসনদসহ একটি বিশেষ ফরাস বিছানো হতো। অন্য কারো সাধ্য ছিল না যে, তাতে পা রাখে। এমনকি আবদুল মুত্তালিবের পুত্রগণও ঐ ফরাসের আশপাশে ও কিনারেই উপবেশন করতেন।

তিনি (সা) যখন আসতেন, অবলীলায় ঐ ফরাসে গিয়ে বসে পড়তেন। এ বয়সে ছেলের ওখানে বসা বেমানান ভেবে তাঁর চাচা তাঁকে ঐ আসন থেকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হলে আবদুল মুত্তালিব পূর্ণ আনন্দের সাথে বলতেন, আমার এ সন্তানকে তার অবস্থায় ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম, তার মধ্যে নতুনতরো কিছু বৈশিষ্ট্যের আভাস পাচ্ছি। অতঃপর সরে গিয়ে নিজের কাছে টেনে বসাতেন আর তাঁর প্রতি তাকিয়ে আনন্দিত হতেন।

সীরাতে ইবন হিশাম, ‘উয়ূনুল আসার’ ও ‘মুস্তাদরাকে হাকিম’-এ কিনদীর ইবন সাঈদ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, জাহিলী যুগে আমি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হজ্জের উদ্দেশে মক্কায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, এক ব্যক্তি তাওয়াফরত, সে মুখে এ কবিতা আবৃত্তি করছে :
“হে আল্লাহ, আমার সওয়ার মুহাম্মদকে ফিরিয়ে দিন এবং আমার প্রতি সর্বোত্তম অনুগ্রহ করুন।”
আমি লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কে? তারা বলল, তিনি আবদুল মুত্তালিব, নিজ দৌহিত্রকে হারানো উট খুঁজতে পাঠিয়েছেন। কেননা যে কাজে তাঁকে পাঠানো হয়, তাতে তিনি অবশ্যই সফলকাম হন। তিনি অনেকক্ষণ পূর্বে গেছেন । এজন্যে আবদুল মুত্তালিব অস্থির হয়ে এ কবিতা পাঠ করছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ফিরে আসেন এবং উটটি তাঁর পিছনে ছিল। দেখামাত্র আবদুল মুত্তালিব তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, বৎস, আমি তোমার জন্য খুবই পেরেশান ছিলাম। এখন থেকে আমি আর কখনো তোমাকে আমার হতে পৃথক হতে দেব না।

আবদুল মুত্তালিবের ইনতিকাল

দু’বছর পর্যন্ত তিনি (সা) স্বীয় পিতামহ আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে থাকেন। বয়স যখন আট বছর হলো, তখন আবদুল মুত্তালিবও এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ৮২, ৮৫, ১৫, ১১০ অথবা ১২০ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন এবং তাকে জহুন-এ দাফন করা হয়। আবূ তালিব যেহেতু হযরত আবদুল্লাহর সহোদর ভাই ছিলেন, এজন্যে মৃত্যুকালীন সময়ে আবদুল মুত্তালিব তাঁকে আবূ তালিবের হাতে সোপর্দ করেন এবং ওসীয়ত করেন যে, স্বচ্ছন্দচিত্তে পরিপূর্ণ ভালবাসা দিয়ে তার অভিভাবকত্ব ও লালন-পালন করবে। উম্মে আয়মান বলেন, যখন আবদুল মুত্তালিবের জানাযা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে তার পিছু পিছু যাচ্ছিলেন।
একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, আবদুল মুত্তালিবের ইনতিকালের কথা কি আপনার স্মরণ আছে ? তিনি বললেন, হ্যাঁ, ঐ সময় আমার বয়স ছিল আট বছর।

আবূ তালিবের তত্ত্বাবধানে

আবদুল মুত্তালিবের ইনতিকালের পর তিনি তাঁর নিজ চাচা আবূ তালিবের তত্ত্বাবধানে আসেন। আবূ তালিব তাঁকে নিজ সন্তানদের চেয়েও বেশি স্নেহ করতেন এবং আনন্দ ও আগ্রহের সাথে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তাঁর লালন-পালন ও অভিভাবকত্বের হক পুরোপুরি আদায় করেন।

পরিতাপের বিষয় যে, এত মহব্বতের সাথে তাঁকে লালন-পালন করা সত্ত্বেও ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য থেকে তিনি বঞ্চিতই থেকে গেলেন। একবার মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে লোকজন আবূ তালিবকে বৃষ্টির জন্য দু’আ করতে অনুরোধ করে। তিনি একদল লোকের সাথে ভবিষ্যত নবী ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ (সা)-কেও সঙ্গে নিয়ে কাবাগৃহে গমন করেন এবং কাবাগৃহের দেয়ালের সাথে তাঁর পিঠ ঠেকিয়ে দেন। অতঃপর একান্ত অনুনয় বিনয়ের সঙ্গে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করেন, যেখানে মেঘের কোনই চিহ্ন ছিল না। তিনি ইঙ্গিত করামাত্র চারিদিক থেকে মেঘ ছুটে এল এবং এত বৃষ্টিপাত হলো যে, সমস্ত নালা-খালে পানি প্রবাহিত হলো। এ উপলক্ষে আবূ তালিব বলেন—”তাঁর চেহারা এতই উজ্জ্বল ও আলোকময় যে, ঐ চেহারার বরকতে আল্লাহর নিকট থেকে বৃষ্টি চাওয়া হয়। যিনি ইয়াতীমের আশ্রয়স্থল এবং বিধবাদের অবলম্বন ও সহায়।

সূত্র: সীরাতুল মুস্তফা সা.
সংকলনে: আহমাদ আল গাজী