আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া
ধর্মীয় চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধ চেতনা কি একটি অপরটির বিপরিত?
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস, বোধের উপর আঘাত হানে এমন কোন অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতেই একটি চিহ্নিত মহল থেকে রবরব উঠে, এসব কর্মকাণ্ড নাকি মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধী৷
অধর্মীয় কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করতেই ঐ মহল চিৎকার শুরু করে, মৌলবাদী গোষ্ঠিকে এখনই রুখতে হবে৷
ব্রাক্ষ্যবাদ, রামবাদ, ঠাকুরবাদ, ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদের হিংস্র ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই তথাকথিত প্রগতিশীল গোষ্ঠী গলা ফাটিয়ে আওয়াজ তুলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুন্ঠিত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে৷
পাঠ্যবই থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর চেতনা বিরোধী আপত্তিকর লেখা বাদ দেয়ার দাবী করতেই রামবাবুদের উচ্ছিষ্টভোগীরা একযোগে চেচিয়ে উঠে, ৭১এর চেতনা বিরোধীদের উত্থান অবিলম্বে রুখতে হবে৷
সর্বোচ্চ আদালতের সামনে ভিনদেশী ধর্মাবলম্বীদের দেবী স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই মস্তিস্ক পচা বুদ্ধিজীবিরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেল গেল বলে চেঁচামেচি করে৷
নগ্নতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা রোধের দাবী উঠাতেই পশ্চিমা সেবাদাসরা ধর্মান্ধতা, পশ্চাৎপদতার অজুহাত দাঁড় করিয়ে দেয়৷
প্রশ্ন হল মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বলতে কি বুঝায়? আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ কি ধর্মীয় চেতনার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল, না জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের আজাদীর লড়াই ছিল? না অপশাসনের বিরুদ্ধে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল? না স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামীদের লড়াই ছিল?
এ যুদ্ধ তো কোন ধর্মীয় চেতনা, বোধ-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ছিল না৷ আমাদের মুক্তির সংগ্রাম তো ইসলামের শ্বাশত আদর্শের বিরুদ্ধে ছিল না৷ বাংলাদেশ থেকে ইসলামী বোধ-বিশ্বাস তাড়িয়ে রামবাবুদের পৌরানিক ধ্যানধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল না৷ ইসলামী কৃষ্টি-কালচার ধংস করে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার জন্য ছিল না৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি বিরোধী চেতনা থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল, প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধাদের কেউ এধরনের দাবী করতে পারবে না৷ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দাবীদার আওয়ামী লীগও এ দাবী করে বলে কেউ বলতে পারবে না৷ আমি হাইব্রীড আওয়ামীদের কথা বলছি না৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আওয়ামী নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের কথা বলছি৷
মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবও এমন বক্তব্য, বিবৃতি দিয়েছেনে বলে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না৷ ৭ই মার্চের ভাষণ কিংবা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পরবর্তী ভাষণে তিনি কি একটিবারের জন্যও বলেছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে? মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের কোন মিটিং-এ এধরনের রেজুলেশন কি পাশ করান হয়েছিল?
মুক্তিযুদ্ধ কারা করেছেন? সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধাদের ধর্মবিশ্বাস কি ছিল? তারা কি যুদ্ধকালীন কিংবা পূর্বাপরে তাদের ধর্মীয় বোধ,বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছিলেন? মুক্তিযুদ্ধের সময় কি বেতার বাংলা থেকে পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াত হত না? তারা কি আল্লাহর নাম নিয়ে শত্রুবাহিনীর উপর ঝাপিঁয়ে পরেননি? আজ ধর্মীয় চেতনা কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরিত হিসেবে দাঁড় করান হচ্ছে কাদের নেমক হালালির জন্য? আজকে ধর্মীভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে এত বিতর্ক কেন? ধর্মীয় রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীতার তগমা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন?
মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের অধিকাংশের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছে ধর্মীয় রাজনীতির মাধ্যমে৷ বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির সুচনার কথা সকলেরই জানা৷ ধর্মীয় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগই শেখ সাহেবকে জন্ম দিয়েছে৷ ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ডের দাবীর সংগ্রামে প্রথম সারীর একজন ছিলেন শেখ সাহেব৷ তিনিও তো অন্যান্য মুসলিম লীগারদের ন্যায় স্লোগান তুলেছিলেন “পাকিস্তান কা মতলব কিয়া হায়? লা ইালাহা ইল্লাল্লাহ”৷ তাঁর রাজনৈতিক গুরুর সকলেই ধর্মীয় রাজনীতির পুরোধা ছিলেন৷ হোসাইন সোহরাওয়ার্দী, ভাষানী, শামছুল হক ও জিন্নাহর নাম উল্লেখযোগ্য৷
শেখ সাহেব কি তাঁর কোন বক্তব্য, বিবৃতিতে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে মহাঅপরাধ করেছেন বলে কোন ধরনের অনুতপ্ত হয়েছেন, এমন দাবী কেউ কি করতে পারবে?
কিছু লোক মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাসীদের ক্ষুদ্র অংশ যেভাবে মুক্তিযুদ্বের বিরোধীতা করেছিল, ঠিক সেভাবে সংখ্যালঘুদের একটা অংশও মুক্তি সংগ্রামের বিপক্ষে ছিল৷ তাদের কেউ কেউ তো স্বাধীনতা লাভের পরও বাংলাদেশে ফিরে আসেনি৷ কয়েকটি রাজনৈতিক দলও মুক্তি সংগ্রামের বিরোধীতা করে পাকিদের পক্ষাবলম্বন করেছিল৷ এ কাতারে যেভাবে ধর্মীয় দলও ছিল, তদ্রূপ কম্যুনিষ্ট রাজনৈতিক দলও ছিল৷ কই! কেউ তো তাদের নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করছে না৷ কেউ তো কম্যুনিষ্ট রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী করছে না৷
পাঠ্যপুস্তক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস বিরোধী বিষয়াবলী বাতিল করা নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হয়েছে৷ ও তে ওড়না লেখার দ্বারা সাম্প্রদায়িকতা উচকিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গ্রীক দেবীর উৎখাতের দাবীও নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী! কথাবার্তায় মনে হয় গ্রীক দেবীর জন্যই মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছিল৷
এ কথা সকলের স্মরণ রাখতে হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মীয় চেতনা বিরোধী মানসিকতা থেকে তৈরী হয়নি৷ যারা এ ধরনের আবল তাবল বকওয়াছ করছে, তারা সে সময়েও মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে ছিল না৷ এখনো দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌম ধংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত৷