নেতৃত্বের ময়দানে উলামায়ে কেরাম ও বর্তমান সমাজ

বর্তমান সময়ে উলামায়ে কেরামের ভূমিকা

প্রতিটি দেশের যেমন একটি সীমানা থাকে, সীমান্ত প্রহরী থাকে— ঠিক তদ্রূপ ইসলামেরও একটি সীমানা আছে। প্রতিটি কাজ, চিন্তা ও সকল বিধি-বিধানের জন্য ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট চৌহদ্দি, সুনির্দিষ্ট অবকাঠামো। এর ভেতরে যা পড়ে তা ইসলাম, যা পড়ে না তা ইসলাম নয়। ইসলামি বিধি-বিধানের এই মহান সীমান্ত যারা পাহাড়া দেন, যারা ইসলামকে নিজ রূপে উপস্থাপন করেন— তারা হলেন উলামায়ে কেরাম। দ্বীন সংরক্ষণের অতন্দ্র প্রহরী। 

আরবি উলামা শব্দটি বহুবচন; এর একবচন আলেম। যার অর্থ— জ্ঞানী, প্রাজ্ঞব্যক্তি। কিন্তু এই ছোট্ট শাব্দিক সংজ্ঞায় একজন আলেম বা উলামায়ে কেরামের পরিচয়টা ঠিক ফুটে ওঠে না। হাদিসে এসেছে, উলামায়ে কেরাম নবীর ওয়ারিশ তথা উত্তরাধিকারী। কতবড় সম্মান! একজন আলেম শুধু একজন জ্ঞানী ব্যক্তিই হন না; তার আরো কিছু অবিচ্ছেদ্য গুণ থাকে, বৈশিষ্ট্য থাকে।

আল্লাহ তার মনোনীত এই দ্বীন সংরক্ষণের জন্য যুগে যুগে অবিচ্ছিন্নভাবে ওলামায়ে কেরামের জামাত সৃষ্টি করে থাকেন— যারা সকল লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি এবং চরম প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে দ্বীন রক্ষার মিশনে নিজেদের উৎসর্গ করে দেন। হাদিসে উলামায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে—

‘প্রত্যেক প্রজন্মের নির্ভরযোগ্য নেককার উত্তরসূরীরা (পূর্বসূরীদের কাছ থেকে) এই দ্বীনী ইলম ধারণ করবে। আর ভ্রান্তদের বিকৃতি, ইসলামবিরোধী বাতিলপন্থিদের মিথ্যাচার এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা বিদূরিত করবে (এবং দ্বীনের স্বরূপ সংরক্ষণ করবে)’।

সত্যি বলতে, বর্তমান সময়টা একদমই ভালো যাচ্ছে না। দেশীয় পরিস্থিতি কিংবা বৈশ্বিক নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা— মানুষ মূলত ভালো নেই। মুসলমানরা ভালো নেই। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চাপে পিষ্ট হয়ে মানুষ দ্বীন-ধর্ম সব ভুলে বসেছে। অবক্ষয় ও অনৈতিকতা ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। এমন একটা অবস্থায় নবীর উত্তরাধিকারী হিসেবে উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। আমি মনে করি, বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে উলামায়ে কেরাম বেশ কয়েকভাবে সমাজে অবদান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

১. আল্লাহমুখী হওয়া ও সর্বস্তরের মুসলমানকে আল্লাহমুখী করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালু রাখা। উলামায়ে কেরামের চিরকালীন মহান এক দায়িত্ব এটি। বর্তমান সময়ে তো এটি সবচে প্রাসঙ্গিক। 

২. মানুষকে প্রশান্তির বার্তা দেওয়া। বর্তমান সময়টাতে মানুষ সবচে বেশি উদ্বেগ ও অস্থিরতায় জীবন কাটাচ্ছে। সুখপাখি যেন উধাও। অফিস, ঘর, রাজপথ কোথাও একটুকু স্বস্তি নেই। তাই উম্মাহর পথপ্রদর্শক ও নবীর ওয়ারিস হিসেবে উলামায়ে কেরামের কর্তব্য হবে, মানুষকে শান্তি ও প্রশান্তির বার্তা দেওয়া। তাদের আবেগটা অনুভব করা, তাদের সঙ্গে মেশা, তাদের সকল প্রশ্ন ও দ্বিধা দূর করা। শুক্রবার জুমার মিম্বারে ও ওয়াজের ময়দানে এ কাজটা হচ্ছে; তবে এর পরিসর আরো বৃদ্ধি পাওয়া উচিত।

৩. সমকালীন সকল বিষয়ে জ্ঞান রাখা ও মানুষের মুখোমুখি হওয়া। সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে যাওয়া। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন। অনেকেই নিজ কর্মপরিসর শুধু ধর্মীয় বিষয়াদিতেই সীমিত রাখতে চান। 

আমি বলব, কাজের পরিধি বাড়ান। সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পারদর্শিতা অর্জন করুন; একজন নেতা হিসেবে অন্তত স্বাভাবিক জ্ঞানটুকু রাখুন; মানুষের মুখোমুখি হোন। ইসলামকে সংসদে ও সচিবালয়ে নিতে হলে যে যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজন, তা অর্জন করুন। তাদের সঙ্গে মিশে যান। আধুনিক সমাজের শিক্ষিতশ্রেণীর মনে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা জাগ্রত করুন।

৪. প্রতিজন আলেম একেকজন সমাজ-সংস্কারক হয়ে উঠুন।

৫. ব্যাপক পরিসরে সমাজসেবায় এগিয়ে আসুন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোতে বাইরের কেউ যেন দারিদ্র্যের সুযোগ নিতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।

পাশাপাশি সর্বপ্রথম তাকে একজন ভালো আলেম হতে হবে। সার্বিক বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী সজাগ-সচেতন হতে হবে। সমকালীন বিষয়গুলোতে জ্ঞান রাখতে হবে। কখনো আবেগতাড়িত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। দূরদর্শী হতে হবে। নিষ্ঠা, সততা ও আমানদারিতা লাগবে। বিপুল সাহসী, আত্মবিশ্বাসী ও মোহনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে। অনুসন্ধিৎসু ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারঙ্গম হতে হবে। 

আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম, ন্যায়পরায়ণতা ও সুদূরপ্রসারী কল্পনাশক্তিও নেতৃত্বের জন্য আবশ্যক। 

নেতৃত্বের জন্য বহুমুখী দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা

দক্ষ নেতৃত্বের জন্য বিচক্ষণ ও কৌশলী হওয়ার পাশাপাশি বহুমুখী দক্ষতা ও যোগ্যতা লাগবে। একজন দলনেতার জন্য খুবই জরুরি একটা বিষয় হলো আত্মবিশ্বাস। নেতাই যদি আত্মবিশ্বাসী না হয়, কর্মীরা ভেঙে পড়ে; সমাজের মানুষ ভরসা হারিয়ে ফেলে। আর এই আত্মবিশ্বাস তখনই তৈরি হবে, যখন নেতা নানা বিষয়ে দক্ষ ও যোগ্য হবে। তাছাড়া, নেতার নেতৃত্ব পরিমাপ করা হয় তার প্রতি কর্মী ও অনুসারীদের আস্থা দেখে। আর সর্বস্তরের অনুসারী ও সমাজের আস্থা পেতে হলে বহুমুখী যোগ্যতা ও দক্ষতার বিকল্প নেই।

মসজিদ-মাদরাসার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারে আলেমদের করণীয়

আমাদের এই অঞ্চলে একটা ধারণা বদ্ধমূল আছে যে, উলামায়ে কেরাম শুধু মসজিদে কাজ করবে। কিন্তু সালাফে সালেহীনের ইলমি ও দাওয়াতি কাজ শুধু মসজিদ-মাদরাসায় সীমাবদ্ধ ছিল না। সমাজ-সংস্কারক হতে হলে আপনাকে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অন্যায়-অনিয়ম নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন, এটা জানান দিতে হবে। দেশের সুশীল নাগরিক থেকে নিয়ে প্রান্তিক জনপদ পর্যন্ত দ্বীনের দরদি আহ্বান নিয়ে যেতে হবে।

সমাজ ও যুগের ভাষায় কথা বলতে হবে। যোগ্যতার কারণে অন্তত আপনাকে যেন কেউ কখনো অবহেলা না করতে পারে। প্রচুর পড়াশোনা করুন। বহুমুখী দক্ষতা অর্জন করুন। মিডিয়ায় আসুন। শিল্পসাহিত্য নিয়ে কাজ করুন। সংসদ ও সচিবালয়ে পৌঁছতে রাজপথের সংগ্রামেও যুক্ত হোন। দাওয়াতি কাজে অনলাইনের বৃহৎ প্লাটফর্মকে কাজে লাগান। ভ্রান্ত ফিরকাগুলোর অপতৎপরতা রোধে দেশের গ্রামীণ জনপদগুলোতে ছুটে যান।