পাঠ্যপুস্তকে ইসলাম বিরোধী পাঠ প্রত্যাহার করে বিশেষজ্ঞ আলেমদের যুক্ত করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন বোর্ড তৈরি করুন: জমিয়ত                              

পয়গাম ডেস্ক :

৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ রোববার বেলা ১২ টায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এর উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে বিজাতীয় আগ্রাসন বন্ধ, অনৈসলামিক বিষয়গুলো বাতিল এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে বিশেষজ্ঞ আলেমদের যুক্ত করার দাবীতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।  হাফিজ শাব্বীর আহমদ এর পবিত্র তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জমিয়তের সিনিযর সহ সভাপতি আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক। দলের প্রচার সম্পাদক মাওলানা জয়নুল আবেদীনের সঞ্চালনায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জমিয়তের কেন্দ্রীয় মহাসচিব কারানির্যাতিত মজলুম জননেতা আল্লামা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। 

অন্যানের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি আল্লামা আবদুর রব ইউসুফী, এডভোকেট মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, মাওলানা লোকমান মাজহারী, ডক্টর মাওলানা শোয়াইব আহমদ, মাওলানা মুতীউর রহমান গাজীপুরী, সহকারী মহাসচিব মাওলানা বশির আহমদ, ঢাকা মহানগরী উত্তর শাখার সভাপতি শায়খুল হাদীস মাওলানা মকবুল হোসাইন কাসেমী, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতী নাসির উদ্দীন খান, সহকারী প্রচার সম্পাদক মাওলানা নুর মোহাম্মদ কাসেমী, অর্থসম্পাদক মুফতী জাকির হোসাইন কাসেমী, সহ অর্থ সম্পাদক মাওলানা আবুল বাশার, অফিস সম্পাদক মাওলানা আবদুল গফফার ছয়ঘরী, যুব বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা বশীরুল হাসান খাদিমানী প্রমূখ।  

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!

    সর্বপ্রথম মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা ও মহামহিম প্রতিপালক। দুরূদ ও সালামের হাদিয়া পেশ করছি হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে এ পৃথিবীতে শুভাগমন করে স্বীয় উম্মতকে সর্বক্ষেত্রে সর্বোত্তম আদর্শের শিক্ষা দিয়েছেন। 

অতঃপর আমাদের আহবানে সাড়া দেওয়ায় আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা করি নিজ নিজ সংবাদ মাধ্যমে আমাদের বক্তব্য ও দাবী-দাওয়াসমূহ প্রচার করে আপনারা প্রতিশ্রুত প্রতিদানের অংশীদার হবেন।

সুপ্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!

   মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে নতুন প্রজন্মের মুসলিম জাতিসত্তা ধ্বংসের পরিকল্পনা দেখে চরম উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা নিয়ে আমরা আজ এই সংবাদ সম্মেলন আহবান করতে বাধ্য হয়েছি। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে এমন অনেক বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে যা এ দেশের মানুষের বোধ- বিশ্বাস ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিপূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। বিতর্কিত এই শিক্ষা সিলেবাসে ইসলামের অকাট্য বিধান পর্দাকে বিকৃতরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে, সুকৌশলে চালানো হয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং অস্বীকার করা হয়েছে ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলের গৌরবময় ইতিহাস। আমরা আজ আপনাদের মাধ্যমে সরকার ও সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে সংক্ষেপে এর কিছু চিত্র তুলে ধরছি।

১. ষষ্ঠ শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” বইয়ে বিবর্তনবাদকে প্রমোট করে বলা হয়েছে: মানুষ কোথা থেকে এল! শুরু থেকে মানুষ একই রকম থাকেনি। বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের বর্তমানরূপে আসা। বিবর্তন হলোই বা কীভাবে? এই বইয়ে বিবর্তনবাদকে বুঝাতে গিয়ে বিভিন্ন যুগের মানুষের বিবর্তিত একাধিক ছবিও দেখানো হয়েছে। এসব ছবি মূলত বিবর্তনেরই প্রমাণ বহন করে। অথচ আমাদের আক্বীদা-বিশ্বাস হল: এই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ আদিকাল থেকেই পূর্ণাঙ্গরূপে সৃজিত হয়েছে এবং তা মহাজ্ঞানী স্রষ্টা মহান আল্লাহরই নিপুন সৃষ্টি। ন্যায়নিষ্ঠ বিজ্ঞানীরা এই চিরন্তন সত্যকে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং বিবর্তনবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সুতরাং বিবর্তনবাদ ঈমান বিরোধী একটি কুফরী মতবাদ। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত দ্বারা এটিই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য। যারা বিজ্ঞানী পরিচয় ধারণ করে এই অবৈজ্ঞানিক দর্শনটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন তারা মূলতঃ মরীচিকার পেছনেই নিরন্তর ছুটছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।

২. সপ্তম শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” বইয়ের ৫১ নং পৃষ্ঠা থেকে আরম্ভ হওয়া “শরীফার গল্প” নামক আলোচনাটি এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বলে আমরা মনে করি। কারণ এই আলোচনাটিতে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানিকৃত বিকৃত মতবাদের দীক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। এ রকম আলোচনা ও পাঠ দ্বারা সমকামিতাসহ নানা ধরণের বিকৃত ও অবাধ যৌনাচারের দিকে কিশোরদের আকৃষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। 

৩. সপ্তম শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” (অনুশীলন) বইয়ের ১২১ নং পৃষ্ঠায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা “অবরোধবাসিনীর” কাহিনীতে এমন কিছু অংশ উল্লেখ করা হয়েছে যা দ্বারা ইসলামী শরীয়তের ফরজ বিধান পর্দার প্রতি বিদ্বেষ ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেয়েছে বলে আমরা মনে করি। বোরকা পরিহিতা বা পর্দা করা নারীদেরকে নির্বোধ ও মূর্খ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে অবরোধবাসিনী। বোরকা-হিজাব পরার কারণে তারা কীভাবে আগুনে পুড়ে মরছে! কীভাবে ট্রেনের নীচে কাটা পড়ছে! ডাক্তাররা কীভাবে রাগ করে বোরকা পরা রোগী না দেখে চলে যাচ্ছে! কীভাবে তারা রেলওয়ে কর্মচারীর লাথি খাচ্ছে! ইত্যাদি কথাগুলো এই লেখাতে তুলে ধরা হয়েছে। এ সব তুলে ধরে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে পর্দার প্রতি ভীতি ও ঘৃণা তৈরির অপচেষ্টা করা হয়েছে। একটি মুসলিম দেশে পর্দার প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য সম্বলিত লেখা পাঠ্যপুস্তকে কীভাবে স্থান পেল? তা ভেবে আমরা কুল- কিনারা পাচ্ছিনা।

৪. ষষ্ঠ শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” (অনুশীলন) বইয়ের ১৭ নং পৃষ্ঠায় দাড়িকে বোকার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই পৃষ্ঠায় দাড়ি নিয়ে বিদ্রুপাত্মক বিভিন্ন বাক্য লেখা হয়েছে। যেমন- “তুমি মোটেও ভালুক না, একটা বোকা হাঁদারাম মানুষ যার দরকার দাড়ি চাঁছা” 

“তুমি একটা বোকা মানুষ যার দরকার দাড়িগুলো চাঁছা”

“ম্যানেজার বলল- ভালুকটা একটা গবেট যার দরকার ভাল করে শেভ করা আর সে পরে একটা পশমের কোট”

৫. সপ্তম শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” (অনুশীলন) বইয়ের ৩য় পৃষ্ঠায় ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজিকে দখলদার হিসেবে দেখানো হয়েছে। 

এতে বলা হয়েছে যে, সুদূর তুরস্ক থেকে আগত ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি ১২০৪ সালে আঞ্চলিক বাংলার উত্তর এবং পশ্চিম সীমানার বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেন। এই দখলের প্রক্রিয়ায় তিনি বেশ কিছু বিহার এবং পাঠাগার ধ্বংস করেন। বখতিয়ার খলজির হাত ধরেই বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের শাসন শুরু হয়। এভাবে আরো অনেক জায়গায় ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃতরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।

৬. ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” বই দুটির প্রচ্ছদেও ভিনদেশী সংস্কৃতিকে প্রমোট করা হয়েছে। এসব ছবি মূলতঃ বিবর্তনের প্রমান স্বরূপ দেওয়া হয়েছে। এমন প্রচ্ছদ কোন ভাবেই আমাদের ইতিহাস- ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-সভ্যতাকে রিপ্রেজেন্ট করেনা। 

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!

 অতি সম্প্রতি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য আমাদের নজরে এসেছে এবং শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে এ সব অসংগতির বিষয়ে আলাদা আলাদা দুটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে আমরা জেনেছি। কিন্তু উপরোল্লিখিত জটিল বিষয়গুলোকে শুধু অসংগতি কিংবা ভুল বলে উপস্থাপন করাটাও আমাদের কাছে চরম আশ্চর্যের ব্যাপার। আমরা বরং মনে করি: ঈমানী আক্বীদা-বিশ্বাস ও ইসলামী

মূল্যবোধ পরিপন্থী উপরোক্ত বিষয়গুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তকে যুক্ত হওয়াটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ এবং পূর্ব পরিকল্পিত। তাই সরকারকে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনপূর্বক প্রকৃত দোষীদেরকে চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে বিজাতীয় আগ্রাসন বন্ধ, অনৈসলামিক ও বিতর্কিত বিষয়গুলো বাতিল করে নতুন করে ঢেরে সাজাতে হবে এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে একাধিক বিশেষজ্ঞ আলেমকে যুক্ত করতে হবে। এর পাশা পাশি ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!

 মৌলিকভাবে বর্তমান পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও সমসাময়িক রাজনৈতিক ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কেও আপনাদের মাধ্যমে আমরা আরো কিছু দাবী-দাওয়া পেশ করছি। যা ইতিপূর্বেও আমরা দলীয় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বারংবার বলে আসছি।

* সরকারকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার জনদাবী মেনে নিতে হবে।

* দলীয় নেতৃবৃন্দসহ কারাবন্দী আলেমদেরকে দ্রুত মুক্তি দিতে হবে এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমদরকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কোর্টে আনা বন্ধ করতে হবে। এটা শুধু দৃষ্টিকটুই নয়; বরং অমানবিকও বটে।

* বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য সাধারণ জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে এবং আসন্ন মাহে রমজানকে সামনে রেখে মজুতদারি ও কালোবাজারি রোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

* দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে ফেরত আনার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

*কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা এবং খৃষ্টান মিশনারীর প্রতারণামূলক কার্যক্রম বন্ধে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

ইনশাআল্লাহ পাঠ্যপুস্তক ইস্যু নিয়ে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম উত্তর গেইটে ঢাকা মহানগর জমিয়ত উত্তর ও দক্ষিণ শাখার যৌথ উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।

প্রিয় সাংবাদিক ভাইয়েরা!

 শেষ বারের মত আবারো আপনাদেরকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানিয়ে এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ আমাদের সকলকে ঈমান ও সুস্থতার সাথে চলার তাওফীক দিন। আমীন।

মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী

মহাসচিব

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ