ঢাকার মোহাম্মদপুরে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসা থেকে রহস্যজনকভাবে পড়ে মারা গিয়েছে প্রীতি ওরাং নামের এক গৃহকর্মী। মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুশোকে কাতর হয়ে পড়েছেন তার মা। কোনোভাবেই থামছে না তার আহাজারি।
মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে মোহাম্মদপুরের শাজাহান রোডের একটি বহুতল ভবনের নিচতলা থেকে গৃহকর্মী প্রীতিকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পথেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান।
ওই ভবনের নবমতলায় ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার পরিবার বসবাস করতেন।
প্রীতির মৃত্যুর ঘটনায় থানায় একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় আদালত আশফাক ও তার স্ত্রীকে কারাগারে পাঠিয়ে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ সেখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে প্রীতির মরদেহ কমলগঞ্জ উপজেলার মিতিঙ্গা চা-বাগানে পৌঁছালে এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। প্রীতির এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না কেউ।
তিনদিন আগে প্রীতির শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। সরেজমিনে মিতিঙ্গা চা-বাগানের ফাঁড়ি বাগান হালকি টিলায় গেলে দেখা যায়, প্রীতির বাবা লুকেশ ওরাং, মা নওমিতা ওরাং, বোন স্বপ্না ওরাং ও ভাই সঞ্জয় ওরাং শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন।
প্রীতির বাবা চা শ্রমিক লুকেশ ওরাং বলেন, মৌলভীবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক মিন্টুর ওপর আস্থা রেখে মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। তখন তারা সেখানে আমার মেয়ের ভালো থাকা, সুখে থাকা এবং বাসায় বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। মাসে মাসে টাকাও দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার মেয়েটি লাশ হয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাড়ি ফিরল। আমি আমার সন্তান হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।
তিনি বলেন, আমরা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। মিন্টু আমাকে অনেক ধরনের প্রলোভন দেখিয়েছিল। মেয়ের নিরাপদ জীবনের কথা বলেছিল। আমি এক পর্যায়ে তার কথায় রাজি হয়ে গেলাম। মেয়েকে ঢাকায় পাঠানোর প্রথম দিকে ১০ হাজার টাকা এবং পরে আরও পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল সে। এরপর আর কোনো টাকা-পয়সা দেয়নি। কোনো দিন ওই বাসায়ও নিয়ে যায়নি।
লুকেশ বলেন, ঢাকায় যাওয়ার দুই বছরে আমার মেয়েকে একটিবারের জন্যও দেখতে পাইনি। মেয়েকে কোনো ছুটিও দেয়নি। নানা অজুহাত দেখিয়ে মাসে দুই-একবার গৃহকর্তার মোবাইলে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দিত।
এ সময় প্রীতির মা নওমিতা ওরাং বিলাপ করতে করতে বলেন, আশফাক বলেছিলেন আমার মেয়ের বিয়ের সব খরচ দিবে। মিন্টু সাংবাদিক আমার মেয়েকে ওই বাসায় পাঠানোর জন্য জোরাজুরি করেছিল। কিন্তু আমার মেয়েকে নিয়ে যে তারা মেরে ফেলবে এই কথা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। নিরাপদ জীবনের আশায় পাঠিয়ে ফেরত পেলাম মেয়ের লাশ।
হত্যার অভিযোগ তুলে প্রীতির চাচা লগেন ওরাং বলেন, আমি নিশ্চিত প্রীতিকে ওরা নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে। নিহত প্রীতির সহপাঠী প্রতিবেশী কিশোরী কবিতা ওরাং বলেন, আমি প্রীতি হত্যার বিচার চাই। একই কথা প্রীতির সহোদর বোন স্বপ্না ওরাংয়ের।
মিতিঙ্গা চা-বাগানের হালকি টিলার পূর্ব লাইনের বাসিন্দা অমৃত ওরাং বলেন, প্রীতির সঙ্গে হয়তো কোনো অনৈতিক কাজ করা হয়েছে যা ধরা পড়ে গিয়েছিল। তাই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলা হতে পারে বলে আমার ধারণা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মনু-দলই ভ্যালির সভাপতি ধনা বাউরি বলেন, প্রীতি ওরাংয়ের মৃত্যু আসলেই দুঃখজনক। প্রীতি যে ঢাকায় ওই সাংবাদিকের বাসায় কাজ করতে গেছে, সেটা আমরা বাগানের কেউই জানতাম না। প্রীতির মা ও বাবার সঙ্গে কথা বলে সাংবাদিক মিন্টু দেশোয়ারা গোপনে তাকে ঢাকায় পাঠায়। আমি প্রীতি হত্যায় জড়িতদের তদন্তসাপেক্ষে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমদ বদরুল বলেন, তদন্তে প্রীতি হত্যার প্রকৃত ঘটনা সঠিকভাবে উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।