মোল্লার বই ডটকমের নির্বাহী পরিচালক মাহমুদুল হাছান (২৮)। আট দিন আগে বই ডেলিভারি দিতে গিয়ে আর বাসায় ফেরেননি। এরপর থেকে তার ফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেও তার সন্ধান মিলছে না। তবে ইতোমধ্যে কয়েক দফা তার ফোন নাম্বার ব্যবহার করে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ফোন করেছেন। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তার মুক্তিপণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। সেই সাথে টাকা পাঠানোর জন্য একটি বিকাশ নাম্বার দেওয়া হয়েছে তার বাবাকে।
সেই ফোন নাম্বারের সিমের রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী ঠিকানা বলছে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায়। এই ঘটনায় এখনও পুলিশ কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি। এমনকি মাহমুদুল হাছানকে কারা তুলে নিয়েছে এবং তিনি কোথায় আছেন তাও তারা জানতে পারেনি। তবে তিনি নিখোঁজের আগে একটি অজ্ঞাত নাম্বার থেকে কিছু বই চেয়ে অর্ডার করা হয়েছিল। মাহমুদুল হাছান নিখোঁজের পর সেই নাম্বারটি বন্ধ থাকায় সেটিকে ঘিরে এখন নানা রহস্য দেখা দিয়েছে।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, মাহমুদুল হাছান নিখোঁজ হওয়ার আগে এক ব্যক্তি তাকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে কিছু বই কেনার জন্য কল করেন। এরপর থেকে ফোন নাম্বারটি বন্ধ ছিল। ফলে উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। তার স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন- এক ব্যক্তি এত টাকার বই অর্ডার করল, কিন্তু তার ফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এরপর সর্বশেষ ৯ জানুয়ারি সেই ফোন নাম্বারটি খোলা পাওয়া যায়। সেদিন মাহমুদুল হাছান ফোন করে সেই ব্যক্তির ঠিকানা নিয়ে বইয়ের তালিকা অনুযায়ী সেগুলো নিয়ে পরদিন রওনা দেন। সেই ঠিকানা অনুযায়ী তিনি যেতে পেরেছেন কি না তা জানতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। মাহমুদুল হাছানকে যে ফোন নাম্বারটি দিয়ে কল করা হয়েছিল সেটির রেকর্ড বলছে শুধু গত এক বছরে তাকে সেই ব্যক্তি ফোন দিয়েছেন, আর কাউকে ফোন করেননি। ফলে সেই ফোন নাম্বারের রেজিস্ট্রেশন এবং ব্যক্তির পরিচয় নিয়ে নানা রহস্য তৈরি হয়েছে।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি রহস্যজনক মনে হওয়ায় যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ সেই তদন্তভার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে (সিটিটিসি) দিতে চায়। এজন্য তারা একটি আবেদনও করেছে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছে।
মাহমুদুলের হাছানের বাবা মাওলানা জাফর আহমদ গনমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার ছেলে গত আট দিন ধরে নিখোঁজ। আমরা বিভিন্ন জায়গায় তার খোঁজ করেছি, কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। সবশেষ যাত্রাবাড়ী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি। এরপর থেকে পুলিশ তার খোঁজ করার জন্য মাঠে কাজ করছে। আমার ছেলের স্ত্রী ও এক সন্তান রয়েছে। তার মেয়েটা সবসময় বাবা-বাবা বলে তাকে খুঁজছে। আমার ছেলে কোনো অপরাধ থাকলে সেটা বলা হোক। কিন্তু এভাবে কেউ তুলে নিয়ে যাবে এটা কোনোভাবে কাম্য নয়।’
মাহমুদুল হাছানের বাবা জানিয়েছেন, তার ছেলে নিখোঁজের একদিন পর থেকে সাত থেকে আটবার মাহমুদুল হাছানের ফোন নাম্বার ব্যবহার করে এক ব্যক্তি কল করেছেন। সবশেষ সেই ব্যক্তির সাথে এক মিনিট ২৩ সেকেন্ড কথা হয়েছে জাফর আহমদের। সেই ব্যক্তির সাথে যতবার কথা হয়েছে তিনি শুধু একটি কথাই বলেছেন- আপনার ছেলেকে ফেরত দেওয়া হবে, যদি আপনি পাঁচ লাখ টাকা দেন। এরপর তার বাবাকে একটি বিকাশ নাম্বার দেওয়া হয়েছে এবং সেই বিকাশ নাম্বারে টাকাগুলো পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে সেই বিকাশ নাম্বারে সূত্র ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাহমুদুল হাছানের খোঁজ পাওয়ার জন্য মাঠে কাজ করছে। বিকাশ নাম্বারের সিমের রেজিস্ট্রেশন তথ্য বলছে, যে ব্যক্তির নামে এই সিমটি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে তার ঠিকানা ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায়। কিন্তু সেই সিমের অবস্থান কখনও গোপালগঞ্জ, কখনও সিলেট ও ফরিদপুর, আবার ঢাকায় দেখাচ্ছে। ফলে অজ্ঞাত পরিচয় সেই ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে ধাঁধাঁয় পড়ে গেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
মাহমুদুল হাছানের পরিবারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যা ব-১০) বিষয়টি জানানো হয়েছে।
মাহমুদুল হাছান গত ১০ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবপুর এলাকার বড় মাদরাসা মার্কেট থেকে নিখোঁজ হন। এরপর থেকে তার ফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সবশেষ পরিবারের সাথে তার কথা হয়েছিল- তিনি গ্রাহকের কিছু বই সরবরাহ করে বাসায় ফিরবেন। কিন্তু ওই রাতে আর ফিরে আসেননি। মাহমুদুল হাছান যাত্রাবাড়ী দক্ষিণ কুতুবখালী এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন।
তার নিখোঁজের পর পরিবারের পক্ষ থেকে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। সেই জিডির সূত্র ধরে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে খুঁজে বের করার জন্য কাজ করছে।
যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মোহসিন আলী জানান, মাহমুদুল হাছানের ফোনের সর্বশেষ অবস্থান ছিল গোপালগঞ্জ এলাকায়। সেই এলাকার নেটওয়ার্ক ধরে তিনি নিখোঁজের একদিন পর একজন পুরুষ তার বাবাকে ফোন দিয়েছিলেন বলে তার পরিবার জানিয়েছে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়েছে- তিনি বিষয়টি দেখছেন। এরপর থেকে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে নিখোঁজের সময় তার সবশেষ নেটওয়ার্ক ছিল কদমতলী এলাকার সাদ্দাম মার্কেট। কিন্তু সেদিনের পর মাত্র একবার ফোনটি চালু হয়েছে, এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, তারা নিশ্চিত হয়েছেন মাহমুদুল হাছানকে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়নি। তবে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা সদস্যরা মাঠে কাজ করছেন। বিষয়টি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকেও জানানো হয়েছে। তারাও কাজ করছেন।
রাকিবুল ইসলাম রইস