বিংশ শতাব্দি; ফিলিস্তিনের ভাগ্যবিপৰ্যয়

বিংশ শতাব্দিকে স্বাধীনতার শতাব্দি বললে আমি ভুল করবো না৷ প্রায় গোটা এশিয়া এবং আফ্রিকার অঞ্চলগুলো বিংশ শতাব্দিতে ইউরোপ গোষ্ঠীর পরাধীনতা থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হয়৷ ফিলিস্তিনের জন্য বড়ো দুৰ্ভাগ্য যে, এই শতাব্দিতে তাঁরা কবলিত হয়৷ পরাধীনতায় আটকে পড়ে তাদের মাটি ও ঐতিহ্য; ভূলণ্ঠিত হতে থাকে সেখানের শান্তি ও সমৃদ্ধি৷

এখানে একটু ইতিহাসচৰ্চা করা প্রয়োজন৷ ইতিহাস সাক্ষী যে, ইহুদি গোষ্ঠী বার কয়েক বিভিন্ন জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়েছে৷ কখনো রোমে, কখনো ব্যাবিলনে, কখনো আরবে৷ কিন্তু তারা ছিল কুটিল, চতুর, কাপুরষ আর ধরিবাজ৷ এজন্য তারা কোথাও স্থায়ী হতে পারেনি৷ চরম ধিকৃতি নিয়ে বিতাড়িত হতে হয়৷ এমনকি উসমানি খেলাফতকালে তাদের অনুগত হয়ে থাকতে হয়৷ এরপর তাদের জীবনে হিটলার বিপণ্ন নিৰ্মূল পরিণতি নিয়ে হাজির হয়৷ সে ইতিহাস মনে পড়লে ইহুদিরা এখনো থরথর করে কাঁপে৷ 

১৯২০ খ্রি. সালের পূর্ব থেকে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে৷ তাদের জন্য পুনৰ্বাসন ও পৃথক দেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা পৰ্যন্ত করে বসে৷ ইতিহাস আমাদের বলে— ১৯১৮ সালে ফিলিস্তিনে মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় লক্ষ; আর ইহুদিদের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ষাট হাজার৷ ১৯২২ সাল পৰ্যন্ত তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩ হাজার৷ এরপর একটি নিৰ্দিষ্ট পরিকল্পনার ফোঁকর দিয়ে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে; কমতে থাকে মুসলমানদের সংখ্যা৷ যদ্দরুন ১৯৪৮ সালে ইহুদিরা সাত লাখে পৌঁছে যায়৷ আর গোটা বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফিলিস্তিনের মাটি লুট করে ইহুদিদের জন্য স্বাতন্ত্রিক বানিয়ে দেয়৷ ১৫ মে ১৯৪৮ তারিখে ঐতিহাসিকভাবে ইতিহাসের কালো অধ্যায় রচিত হয়৷ এই তারিখে ইজরাইল নামের ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়৷ 

১৯৪৮ খ্রি. সাল৷ জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ইহুদি গোষ্ঠীরা ফিলিস্তিনিদেরকে মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলে৷ তখন থেকে ৭৫ বছর যাবত স্বাধীনতা ফিরে পেতে অবিরাম ত্যাগ-সংগ্রাম এবং দুঃসাহসী অভিযান চালাচ্ছে স্বদেশপ্রেমীরা৷ কিন্তু ইহুদি গোষ্ঠী পাশবিকতা ও কাপুরষতার পরিচয় বলবৎ রেখে বরাবরই মাতৃভূমিপ্রেমী তৌহিদী জনতার ওপর অমানবিক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে৷ কী নারী, কী শিশু, কী বৃদ্ধ, কী অসুস্থ৷ তারা নিৰ্বিচারে হামলা করে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে৷ 

অক্টোবর মাস, ২০২৩৷ আবার সেই মরণপণ যুদ্ধ৷ এবার প্রথম হামলাটা হামাস চালিয়েছে৷ আঘাতটা প্রথমে হামাস কেন করলো, এ নিয়ে চলছে কলমবাজি আর সমালোচনা৷ অথচ নিৰ্ঘাত সত্য হচ্ছে— ইজরাইল নিজস্ব শক্তিবলে ক্ষমতাধর নয়৷  ইজরাইল বিশ্ব মোড়লদের ছায়াশক্তি৷ ইজরাইল যন্ত্রমাত্র৷ যা কিছু করে, বাটন চাপে পশ্চিমা মোড়লরা৷ এই পশ্চিমানিৰ্ভরশীল ইজরাইল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের জায়গা দখল করে আছে৷ সেখানের অধিবাসীদের ঘরছাড়া করেছে এবং করে যাচ্ছে৷ এখন হামাস আক্রমণ করলে, তাঁর আক্রমণ শতভাগ বৈধ৷ নিজেদের অধিকার ফিরে পাবার আন্দোলন-সংগ্রাম যুদ্ধ-বিগ্রহের পবিত্রতম অধ্যায়৷ এতটুকু কথা বুঝতে ভুল করলে, চিন্তা-চেতনা বৈপ্লবিক বৈধতাকে কঠিন বলে মনে করবে৷ 

তারপরও কথা থাকে৷ ইজরাইল যদি প্রতিশোধপরায়ণ হয়, তবে শিশু, নারী, বৃদ্ধদের ওপর হামলা হচ্ছে কেন? হাসপাতাল গুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে কেন? তারা তো হামাসের লোক নয়৷ তারা বেসামরিক এবং বিশ্ব মানবাধিকারের নীতিবলে তাদের নিরাপত্তা অনিবাৰ্য ছিল৷ অথচ যা ঘটছে, তা হৃদয়বিদারক৷ পশ্চিমারা ইজরাইলকে নগ্ন সহযোগিতা করছে৷ অৰ্থ দিয়ে; সমৰ্থন দিয়ে; অস্ত্র দিয়ে, এবং ইজরাইলি শক্তির গোটা রসদ যুগিয়ে৷ আর ইজরাইল ফিলিস্তিনকে পিষে ফেলছে৷ 

আর অন্যদিকে গোটা মুসলিম সাম্রাজ্য চেয়ে চেয়ে দেখছে৷ কোনো কোনো রাষ্ট্র বিড়ালের সুরে নিন্দা জানাচ্ছে৷ কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হুঙ্কার কিংবা কাৰ্যকরী উদ্যোগ কোনো মুসলিম শাসক নিচ্ছে না৷

হামাস স্বদেশের প্রতি উজ্জীবিত হয়ে হামলা করে৷ এরপর থেকে ইজরাইল একের পর এক হামলা করে যাচ্ছে৷ এখন তাদের হামলার শিকার হচ্ছে ইসরাইল সীমান্ত ঘেষা গাজার মাটি ও মানুষ এবং পিরামিড ঘেষা বহুতল ভবন৷ এই যুদ্ধের ফলাফল কী? এই প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহল নিশ্চিত৷ ফলাফল একটাই৷ যুদ্ধ চলবে৷ নিজেদের মাটির প্রতি যারা প্রাণত্যাগে নিয়মিত, ইজরাইল তাদের ওপর অমানবিক পাশবিক হামলা চালাতে থাকবে৷ একপৰ্যায়ে ফিলিস্তিন যোদ্ধাশূন্য হয়ে যাবে; গাজার মাটি শহিদদের রক্তে ভারী হবে; আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়বে নিৰ্যাতিতদের আৰ্তনাদ৷ যখন ইজরাইল হামলা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাবে আর ফিলিস্তিন বিধ্বস্ত হতে হতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে, তখনি আন্তৰ্জাতিকভাবে মানবতার দোহাই দিয়ে নাটকীয় ভূমিকার পদাৰ্পন হবে৷ ইজরাইলি ক্লান্ত পাষণ্ডদের প্রতি সদয় হয়ে পশ্চিমারা যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব নিয়ে অগ্রসর হবে৷ যেন বিশ্রাম নিয়ে আরো শক্তি সঞ্চয় করে আবারো আক্রমণ করতে পারে৷ প্রক্রিয়াটা হবে এমন— আমেরিকার নেতৃত্বে জাতিসংঘ হামাসের প্রতি বিদ্রুপ ঝারবে; আরব গোষ্ঠী চূড়ান্ত পৰ্যায়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নিন্দা জানাবে৷ এই তো অনেক৷ এবং তখনি আগমন ঘটবে মিত্র গোষ্ঠীর৷ হতে পারে ওআইসির ব্যানারে মিত্রগোষ্ঠীর আবিৰ্ভাব ঘটবে৷ যারা হবে পশ্চিমাদেরই সাজানো নকশার আদলে ধূৰ্ত রেফারি৷ আর এদিকে ফিলিস্তিনের ললাটে সব হারিয়ে সেই সয়ে যাওয়া পরিণতি মেনে নেওয়া৷ 

কী মনে হয়! ফিলিস্তিনিদের রক্ত বিফলে যাবে৷ কখনো না৷ বৰ্তমান যুদ্ধটা শুরু করার পূৰ্বে হামাসের লক্ষ্যই ছিল— পৃথিবী আরো একবার দেখুক যে, ফিলিস্তিনের সমস্যা নিরসন ব্যতীত পৃথিবীতে শান্তিপ্রতিষ্ঠা অলস কল্পনামাত্র৷ এবং বৰ্তমান প্রজন্ম জানুক, পৃথিবীর ঘরে ফিলিস্তিন নামক একজন সদস্য আছে; পশ্চিমা ও আমেরিকার মদদে যেটা নিজ ভূখণ্ডে ইজরাইলের হাতে বন্দি৷ সে যাই হোক৷ ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি প্রজন্ম প্রাণউৎসৰ্গী৷ এবং একদিন ফিলিস্তিন তাঁরা স্বাধীন করেই ছাড়বে৷ ইনশাআল্লাহ…