বিশ্বের ৩৩ দেশের জাতীয় নির্বাচনে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ: গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন

অনলাইন ডেস্ক:

হ্যাকিং ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব রটিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে আসছে ইসরায়েলি একটি প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত ৩৩টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে ‘টিম জর্জ’ নামের ওই প্রতিষ্ঠান। যেটির নেতৃত্বে রয়েছেন ইসরায়েলি স্পেশাল ফোর্সের সাবেক চর তাল হানান (৫০)। ‘জর্জ’ ছদ্মনামে ব্যক্তিগতভাবে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলছে তাঁর এই কার্যক্রম।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামের তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৩০টিরও বেশি গণমাধ্যমের সাংবাদিক এ তদন্তে যুক্ত ছিলেন। আজ বুধবার এ-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হানানের ছদ্মনাম জর্জ। তিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে দূর থেকে প্রভাবিত করে আসছেন। হানান ও তাঁর দলের এসব কর্মকাণ্ডের ফুটেজ ও নথি গার্ডিয়ানের হাতে এসেছে। তবে হানান এসব বিষয়ে মন্তব্য না করে শুধু বলেছেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি।’

ভুল তথ্যকে কীভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে, প্রতিষ্ঠানটি সেটি তদন্তের মাধ্যমে তুলে এনেছে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম। তদন্তে দেখা গেছে, নির্বাচনে গোপনে সূক্ষ্মভাবে হস্তক্ষেপ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এরা রাষ্ট্র কিংবা রাজনৈতিক দল ছাড়াও করপোরেট ক্লায়েন্টদের জন্যও কাজ করে।

তিনজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ছদ্মবেশে হানানের কাছে যান। তাঁরা হানানের কাছে সেবা নেওয়ার কথা বলে গোপন তথ্য তুলে আনেন। তদন্তে থাকা সেসব সাংবাদিককে হানান জানান, তাঁর পরিষেবাগুলোকে অন্যরা ‘ব্ল্যাক অপস’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। তাঁর দাবি, এই প্রতিষ্ঠান মূলত রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা এবং বেসরকারি কোম্পানিকে সেবা দিয়ে থাকে, যারা গোপনে জনমত নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। হানান বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান আফ্রিকা, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপজুড়ে কাজ করছে।

হানানের প্রতিষ্ঠান ‘টিম জর্জ’-এর অন্যতম প্রধান একটি পরিষেবা হলো ‘অত্যাধুনিক সফটওয়্যার প্যাকেজ’। যার নাম অ্যাডভান্সড ইমপ্যাক্ট মিডিয়া সলিউশন (এআইএমএস)। এটি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেমন—টুইটার, লিংকডইন, ফেসবুক, টেলিগ্রাম, জিমেইল, ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউবে হাজার হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো দিয়ে ক্রেডিট কার্ড, বিটকয়েন ওয়ালেট এবং এয়ার বিএনবি অ্যাকাউন্টসহ আমাজন অ্যাকাউন্টও খোলা যায়।

ছদ্মবেশী সাংবাদিকেরা ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে গোপনে হানানের কথা রেকর্ড করেন। হানান এবং তাঁর দলের অন্য সদস্যরা জিমেইল ও টেলিগ্রাম হ্যাকিংয়ের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। প্রতিপক্ষের প্রচারণাকে বাধাগ্রস্ত করতে তাঁরা হ্যাকিং, গুজব রটানোর মতো কাজ করে থাকেন বলে জানান। এমনকি তাঁরা জানান, এক রাজনীতিবিদের বাসায় তাঁর স্ত্রীর জন্য আমাজন থেকে কেনা ‘সেক্স টয়’ পাঠানো হয়। স্বামীর প্রতি সন্দেহ তৈরি করতেই এই অপকৌশল নেওয়া হয়।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, টিম জর্জের এ ধরনের কৌশলের ব্যবহার প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। টিম জর্জের কার্যক্রম এখন প্রকাশ পাওয়ায় এটি ইসরায়েলের জন্য অস্বস্তির কারণ হবে। কেননা সাম্প্রতিক সময়ে এমনিতেই সাইবার-অস্ত্র (বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আড়িপাতার যন্ত্র) রপ্তানি ইস্যুতে চাপে রয়েছে দেশটি।

তবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় টিম জর্জের এমন কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

অনুসন্ধানী তিন সাংবাদিক হানানের কাছে রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যুদস্ত আফ্রিকার একটি দেশের হয়ে পরামর্শ নিতে যান। তাঁরা তথ্য তুলে আনার জন্য এ পন্থা অবলম্বন করেন। তাঁরা হানানের প্রতিষ্ঠানকে বলেন, আফ্রিকার সেই দেশটির নির্বাচন কীভাবে বিলম্বিত করা যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

হানান বলেন, ‘আমরা এখন আফ্রিকার একটি নির্বাচন নিয়ে কাজ করছি। আমাদের একটি দল গ্রিসে এবং একটি দল আমিরাতে কাজ করছে। এ পর্যন্ত ৩৩টি প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে কাজ করে ২৭টিতেই সফলতা এসেছে।’

এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে দুটি ‘বড় প্রকল্পে’ কাজ করার কথা জানান। তবে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তাঁদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই বলে দাবি করেন হানান।

টিম জর্জের সঙ্গে সাংবাদিকদের সেই বৈঠকে পাওয়া সব তথ্য অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা যায়নি বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

হানান সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁরা বিভিন্ন মুদ্রায় পেমেন্ট গ্রহণ করে থাকেন। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে ৬০ লাখ ইউরো থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ ইউরো পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। বা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬৮ কোটি ১৭ লাখ ২৯ হাজার ৮৮৭ থেকে ১৭০ কোটি ৪৩ লাখ ২৪ হাজার ৭১৮ টাকা।

দ্য গার্ডিয়ান এবং তদন্তকারী সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, মেক্সিকো, সেনেগাল, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ প্রায় ২০টি দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য প্রচার ও প্রচারণার পেছনে টিম জর্জের ‘এআইএমএস’ সফটওয়্যারটির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।