বীর মুক্তিযোদ্ধা জমিয়ত নেতা মাওলানা জহিরুল হক ভূঁইয়া 

মাওলানা জহিরুল হক ভূঁইয়া রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী”

জমিয়ত নেতা মাওলানা জহিরুল হক ভূঁইয়া ছিলেন একজন ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব , নিভৃতচারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শাইখুল হাদীস | 

নামঃ মাওলানা জহিরুল হক ভূঁইয়া , ( সর্ব মহলে ভূঁইয়া সাহেব নামে যিনি সমধিকপরিচিত ) 

জন্মঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানাধীন শিকারপুর গ্রামে ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভূঁইয়া বংশে জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতা আঃ গালিম ভূঁইয়া , মাতা মোসাঃ সোনাবানু । তিনি পরিবারের চার ভাই ও তিন বোনের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ । পিতার উপার্জন হিসেবে গ্রামের সাধারণ কৃষি কাজ এবং কয়েক পদের ব্যবসাই ছিল তাদের আয়ের প্রধান উৎস। 

শিক্ষা – দীক্ষাঃ

প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেন । এরপর চারগাছা হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন । এরপর একবার স্বপ্নে দেখেন যে , তিনি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছেন । সেই স্বপ্ন তৎকালিন মুখলিস আলেম মাওলানা নুরুল হক রহ . এর কাছে ব্যক্ত করলে তিনি তাকে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করার পরামর্শ দেন । সেখান থেকেই তিনি সায়দাবাদ গ্রামের প্রাথমিক মাদ্রাসাভিত্তিক পড়াশোনা শুরু করেন । এখানে তিনি নাহবেমির জামা’আত পর্যন্ত পড়েন । অত : পর চলে যান কুমিল্লার বরুড়া দারুল উলুম মাদ্রাসায় । সেখানে জালালাইন জামা’আত পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন । অত : পর চলে যান উম্মুল মাদারিস জামিয়া আহলিয়া মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় । সেখানে মেশকাত পড়ে দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হন । একদিন মেখল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ . তাকে পরামর্শ দেন , জামিয়া ইউনুসিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসতে । ফলে তিনি সাথে সাথেই চলে আসেন (১৯৬৬ সালে) জামিয়া ইউনুসিয়ায় । এখানে তিনি বোখারী শরীফের সনদ লাভ করেন তাঁর শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ . এর কাছ থেকে।

কর্মজীবনঃ 

পড়াশোনা শেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি আখাউড়া মাদ্রাসায় প্রথম বছর খেদমত করেন । অত : পর নিজ এলাকার নিকটস্থ হাইস্কুলে প্রধান মৌলভীর দায়িত্ব পালন করেন । এরপর তিনি নবীনগর থানার কুড়িঘর মসজিদে ইমামতি করেন । অত : পর টঙ্গি দারুল উলুমে চলে আসেন । এরপর তিনি ঢাকার মিরপুরস্থ জামিয়া হুসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদরাসার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রায় দেড় যুগেরও বেশী সময় খেদমত করেন । এরপর কিছুদিন কাউন্দিয়া মসজিদেও দায়িত্ব পালন করেন । অত : পর সাভার বাইপাইল আল আমীন মাদরাসায় কয়েক বছর খেদমত করেন এবং এরপর উত্তরা জামিয়া সোবহানিয়ায় খেদমত করেন । পরবর্তীতে তিনি সেখান থেকে চলে এসে সাভার জামিয়া এমদাদুল উলুম ভাগ্নীবাড়ি মাদ্রাসার প্রধান পরিচালক ও শাইখুল হাদীসের মসনদ অলংকৃত করে হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দেন দীর্ঘ বিশ বছরেরও কিছু অধিক সময় | অত : পর জীবন সায়াহ্নে এসে কিছু অসুস্থতার কারণে ভাগ্নীবাড়ি মাদরাসার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেন । শেষ সময়ে তিনি সাভার দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রধান মুরুব্বি হিসেবে প্রায় তিন বছর হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দেন । এছাড়াও তিনি নিয়মিত সম্পাদনা ও লেখালেখির কাজ করেছেন বিভিন্ন মাসিক ও জাতীয় দৈনিক পত্র – পত্রিকায় | তার নিজের লেখা বইয়ের তালিকায় “ নামাজ : গুরুত্ব দর্শন ও মাসায়েল ” সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । 

মুখরতাঃ 

রাজনৈতিক জীবন সাংগঠনিক কর্মঃ

তিনি ১৯৭১ এর পূর্ব থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত থাকেন। এর মাধ্যমে তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ করেন । আমরণ তিনি এই সংগঠনের সাথেই জুড়ে ছিলেন ( ইন্তেকালের সময় তিনি এ সংগঠনটির সহ – সভাপতির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ) এছাড়াও তিনি খতমে নবুওত আন্দোলন , তাহাফফুযে খতমে নবুওতসহ জাতীয়ভাবে সমাদৃত বহু সংগঠন ও অঙ্গসংগঠনের সাথে কোনো না কোনোভাবে জুড়ে ছিলেন । কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন ও মাজার পুজা বিরোধী আন্দোলনেও ছিল তার সরব ও অগ্রণী ভূমিকা । রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন বেশ প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব । যদ্দরুণ , বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদেরও তার সাথে ছিল মুখচেনা হৃদ্যতার সম্পর্ক । 

সামাজিক উন্নয়নঃ 

তিনি মিরপুর শাহ আলী মাজার কমিটির জয়েন্ট সেক্রেটারী নির্বাচিত হয়েছিলেন । তখন তিনি ঐ এলাকায় প্রচলিত বহু ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ড রোধ করতে সক্ষম হন । বিশেষত মাজারে সিজদা না করার ব্যাপারে জোড়ালো ও কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । মাজারের আশপাশের মার্কেট ও ভিতরের মসজিদ উন্নয়নেও তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ঢাকার মিরপুরস্থ বাড়ির জাহানাবাদ, জহুরাবাদ এলাকায়ও ব্যাপক উন্নয়নের ভূমিকা রাখেন এবং নিজ জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও তিনি বহু উল্লেখযোগ্য কাজ করেন ।

বিবাহঃ

১৯৬৯ সালে ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ . এর মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাস্টার ওয়ালি উল্লাহ সাহেবের বড় মেয়ে মোসাঃ হাফসা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । 

স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণঃ 

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি স্ব – শরীরে অংশ নেন এবং নিজ হস্তে পাক হানাদার ও রাজাকার নির্মূলে অগ্রণি ভূমিকা পালন করেন । তখন তিনি নবীনগর থানাধীন কুড়িঘর মসজিদের ইমাম হিসেবে ছিলেন । ( আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন “ আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে , পৃষ্ঠা -৪৬৭ )

আধ্যাত্মিকতাঃ

দারুল উলুম দেওবন্দ – এ আসা – যাওয়া ছিল তার দিলের আন্তরিক তামান্না । জীবনে দুইবার বাইতুল্লাহ হজ্জের খোস নসীব হয় তার । তিনি হযরতুল আল্লাম আস’আদ মাদানী রহ . – এর বাংলাদেশের সার্বক্ষণিক সফরসঙ্গী হিসেবে থাকতেন । তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা মসজিদে কয়েকবার রমজান মাসের সুন্নাত এ’তেকাফ করেছেন , এবং হযরত আস’আদ মাদানী রহ . – এর বাইয়াত গ্রহণ করেন । আসাতেজায়ে কেরামঃ তিনি ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ . এর খুবই স্নেহধন্য ছাত্র ছিলেন । আল্লামা আহমদ শফি রহ . , আল্লামা আবুল হাসান রহ , আল্লামা সিরাজুল ইসলাম রহ . সহ বহু দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরামের সান্নিধ্য অর্জন করেন। 

পছন্দের কাজঃ 

কুরআন তেলাওয়াত ছিল তার পছন্দের অন্যতম সেরা কাজ । এছাড়া বড়দের জীবনি পড়তে পছন্দ করতেন অত্যধিক । তিনি সার্বক্ষণিকই কিছু না কিছু পড়তেই থাকতেন । যেনো পড়াশোনাই ছিল তার নেশা ও পেশা । মেহমান নাওয়াজীতেও ছিলেন মেছাল , বেনজীর । 

যাদের সাথে পথচলাঃ

আল্লামা শামসুদ্দীন কাসেমী রহ. , শাইখে কাতিয়া সাহেব রহ. , আল্লামা তাফাজ্জুল হক মুহাদ্দিসে হবিগঞ্জী,মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী রহ. , মুফতি ওয়াক্কাস রহ. ,মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. সহ সিলেট ও ঢাকা অঞ্চলের প্রবীণ উলামায়ে দেওবন্দ |

পরিবারবর্গঃ 

স্ত্রী, এক ছেলে (মাহমুদুল হাসান ভূঁইয়া ফুয়াদ) ও তিন মেয়ে ও আপন দুই নাতি তিন নাতনি ধরার বুকে রেখে ইন্তেকাল করেন!

ইন্তেকালঃ 

মহান এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব , গবেষক ও লেখক , প্রবীণ ও সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা , শাইখুল হাদীস আল্লামা জহিরুল হক ভূঁইয়া রহ . ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারী রাত ২:২০ মিনিটে সাভার বিরুলিয়া ইউনিয়নের সামাইরের নিজ বাস ভবনে ইহকাল ত্যাগ করে রফিক্বে আলার ডাকে সাড়া দিয়ে জান্নাতের মেহমান হন ।