বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মোস্তফা আজাদ রহ.

আগমন প্রস্থানের লীলাভূমি এই জগৎ সংসার। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে কত বনি আদমের আগমন ও প্রস্থান হয়েছে তার হিসাব কেউ কোনোদিন রাখেনি। তবে হ্যাঁ, কিছু মানুষ এর ব্যতিক্রম, যাদের আগমন-প্রস্থান জাতি লিখে রাখে স্বর্ণাক্ষরে। সেই সোনালী কাফেলার অন্যতম আল্লামা মোস্তফা আজাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ।

জন্ম: প্রখ্যাত আলেম আল্লামা মোস্তফা আজাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৯৪৯ সালের ১ মে গোপালগঞ্জ জেলার সাধুহাটি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম বাদশা মিয়া।

শিক্ষাজীবন: তিনি সিলেট আলিয়া মাদরাসা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী লালবাগ মাদরাসায় কাফিয়া থেকে জালালাইন জামাত পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম মাদরাসায় মেশকাত জামাতে ভর্তি হন এবং গওহরডাঙ্গা মাদরাসা থেকে তিনি ১৯৬৯ সালে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ গোপালগঞ্জ রামদিয়া কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। সর্বশেষ জামিয়া আরজাবাদে তাফসির শাস্ত্রের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন ।

কর্মজীবন: ফলসী আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষের দায়িত্বপালনের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু তিনি এ দায়িত্ব মন থেকে গ্রহণ করতে পারেননি। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপঢৌকনে তুষ্ট করার অপনীতি তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। ফলে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ।

তারপর ১৯৭৭ সালে ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিরপুরের জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদে তাফসির প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হন। তার নিষ্ঠা, প্রতিভা ও কর্মদক্ষতা দেখে মুজাহিদে মিল্লাত শামছুদ্দীন কাসেমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাকে আরজাবাদে যোগদান করতে বলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি আরজাবাদ মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাকে নায়েবে মুহতামিম পদে নিযুক্ত করে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আল্লামা শামছুদ্দীন কাসেমী রহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তিকালের পর মজলিশে শুরায় সর্বসম্মতিক্রমে তাকে মুহতামিমের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়। আমৃত্যু (২০১৮) তিনি এ দায়িত্ব সুনামের সঙ্গে আঞ্জাম দিয়েছেন।

রাজনৈতিক জীবন: আল্লামা মোস্তফা আজাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন সচেতন ইসলামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাহী সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতিসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তিনি খতমে নবুওয়াত আন্দোলন পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তালিমুল কুরআন বাংলাদেশেরও তিনি ছিলেন সভাপতি। ১৯৯৯ সালে মিরপুরে পবিত্র কুরআন অবমাননার ঘটনা ঘটে। এর বিরুদ্ধে মিরপুরব্যাপী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ‘কুরআন অবমাননা প্রতিরোধ কমিটি” গঠিত হয়। তিনি ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ঢাকা মহানগরীর নায়েবে আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া সারাদেশে কাদিয়ানি, মওদুদি ও এনজিওবিরোধী আন্দোলনে তার সরব ভূমিকা ছিল।

স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ: ১৯৭১সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আল্লামা মোস্তফা আজাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি সরাসরি সশস্ত্রযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার বাবা মেজর বাদশা মিয়া ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানাধীন ধলগ্রাম ইউনিয়নের সাধুহাটি গ্রামের মাঠে যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ খুলেছিলেন তিনি। হানাদারদের প্রতিহত করতে গ্রামের ওই মাঠে স্থানীয় যুবক ও ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে তিনি মেজর অব. আব্দুল জলিলের নেতৃত্বাধীন ৯ নং সেক্টরে (বৃহত্তর খুলনা ও বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল) যুদ্ধ করেন। একাত্তরের প্রথমভাগে তিনি ঢাকায় ছিলেন । ৭ মার্চে তিনি এবং লালবাগ মাদরাসার আরো কিছু শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। পরে বিভিন্ন জায়গায় হত্যা, জুলুম, নির্যাতন শুরু হলে ২৫ মার্চ রাতে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেদমত: আল্লামা মোস্তফা আজাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ২০১৪ সালে রাবেতাতুল আলম আল ইসলামি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য সৌদি আরবে পবিত্র মক্কা নগরী গমন করেন। এছাড়া ২০১১ সালে মজলিশে সওতুল ইসলাম পাকিস্তানের আমন্ত্রণে আলমি সিরাত কনফারেন্স পাকিস্তান সম্মেলনে অংশ নিতে পাকিস্তান সফর করেন। একাধিকবার তিনি হজব্রত পালন করেছেন। দারুল উলুম দেওবন্দসহ ভারতের ঐতিহাসিক বিভিন্নস্থানও তিনি সফর করেছেন।

আধ্যাত্মিক সাধনা: আল্লামা মোস্তফা আজাদ রহমাতুল্লহি আলাইহি ছাত্র জীবন থেকেই দেশের উল্লেখযোগ্য বুজুর্গদের দূর্লভ সংস্পর্শ ও স্নেহদৃষ্টি লাভে ধন্য হয়েছেন। তাদের অন্যতম হলেন- আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তাদের ইন্তিকালের পর ফেদায়ে মিল্লাত আওলাদে রাসুল আল্লামা আসআদ মাদানি রহমাতুল্লাহি আলাইহির বিশেষ ফয়েজ লাভে সিক্ত হন এবং আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভ করেন। তার ইন্তিকালের পর আল্লামা সাইয়্যিদ আরশাদ মাদানির সান্নিধ্য গ্রহণ করেন ।

রচনা ও লেখালেখি: আল্লামা মোস্তফা আজাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিকও ছিলেন। তার ক্ষুরধার সৃজনশীন লিখনী, সারগর্ভ যুক্তিপূর্ণ তাত্ত্বিক আলোচনা ছিল বিস্ময়কর। তিনি মহিলাদের মসজিদে গমন ও পর্দার বিধান এবং শানে সাহাবা (অনুবাদ) নামক দু’টি পুস্তিকাসহ অসংখ্য সাহিত্যকর্ম আঞ্জাম দিয়েছেন। একসময় তার সম্পাদনায় জামিয়া আরজাবাদের মুখপত্র ‘মাসিক পয়গামে হক’ প্রকাশিত হতো।

ইন্তেকাল: ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তিত্ব ২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকাল নয়টা পয়তাল্লিশ মিনিটে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দেন। উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খে সানি হজরতুল আল্লাম শায়খ আবদুল হক আযমী রহমাতুল্লাহি আলাইহির সাহেবজাদা হজরত মাওলানা আবদুল বার আযমী তার জানাযার ইমামতি করেন। জামিয়া আরজাবাদ সংলগ্ন গোলারটেক ঈদগাহ ময়দানে বাদ মাগরিব হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে হজরতকে দাফন করা হয়।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি জামিয়া আরজাবাদে প্রায় ৪০ বছর খেদমত করেছেন । এর মাঝে ২২ বছর মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি তিনি একাধারে অসংখ্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক, কওমি শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহ-সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি, খতমে নবুওয়াত আন্দোলন পরিষদের নির্বাহী সভাপতি, মাদরাসা কল্যাণ পরিষদ বাংলাদেশের সভাপতি, তালিমুল কুরআন বাংলাদেশের সেক্রেটারি, মাদানি পরিবারের সফর ইন্তেযাম ও ইস্তেকবালিয়া কমিটির সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। দয়াময় আল্লাহ তার খেদমতগুলো কবুল করুন। আমিন।