মদিনা শান্তির ও আধ্যাত্মিকতার প্রাণকেন্দ্র

মদিনাতুর রাসুল। যে নাম উচ্চারণেই হৃদয়ে শান্তির বাতস অনুভব হয়। মুমিন হৃদয়ে প্রেমের জোয়ার এনে দেয়। এটি এমন একটি স্থান, যেখানে আকাশ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, আর জমিন গর্বে নিজের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে যে, তার ভেতর শুয়ে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। প্রিয় নবীজি (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর ইসলামের নবযুগের গোড়াপত্তন হয়েছে এই পবিত্র নগরীতে। যা এই নগরীকে করেছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শহরগুলোর অন্যতম। মদিনা শুধু একটি শহর নয়, এটি প্রেম, শ্রদ্ধা ও আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য মিলনমঞ্চ। এই শহর নিয়ে নবীজির মুখ থেকে উচ্চারিত প্রশংসার বাণী।

মদিনার জন্য বরকতের দোয়া

মদিনা নবী করিম (সা.)-এর বসতি ও মসজিদে নববীর শহর। এটি হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের প্রতিষ্ঠার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নবী করিম (সা.) চেয়েছিলেন, মদিনা যেন মক্কার চেয়েও বেশি বরকতপূর্ণ হয়, কারণ এখানেই ইসলামিক জীবনব্যবস্থার মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছে। তাই তিনি মদিনার জন্য দিগুন বরকত লাভের দোয়া করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! মক্কাতে তুমি যে বরকত দান করেছ, মদিনাতে এর দ্বিগুণ বরকত দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮৫)’

মদিনার প্রতি আবেগ 

প্রিয় নবীজি (সা.) মদিনাকে দূর থেকে দেখে অনন্দ অনুভব করতেন। নিজের বাহনকে দ্রুত হাঁকাতেন প্রিয় শহরের দিকে। আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) সফর থেকে ফিরে আসার পথে যখন তিনি মদিনার প্রাচীরগুলোর দিকে তাকাতেন, তখন তিনি তাঁর উটকে দ্রুত চালাতেন আর তিনি অন্য কোনো জন্তুর ওপর থাকলে তাকেও দ্রম্নত চালিত করতেন, মদিনার ভালবাসার কারণে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮৬)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! মদিনাকে আমাদের কাছে প্রিয় বানিয়ে দাও যেমন মক্কা আমাদের কাছে প্রিয় বা এর চেয়েও বেশি। হে আল্লাহ! আমাদের সা ও মুদে বরকত দান কর এবং মদিনাকে আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর বানিয়ে দাও। স্থানান্তরিত করে দাও জুহফাতে এর জরের প্রকোপ বা মহামারীকে।  (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮৯)

মদিনায় মৃত্যুর ফজিলত

ইবন ওমর (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, মদিনায় মৃত্যুবরণ করা যদি কারো পক্ষে সম্ভব হয়, তবে সে যেন মদিনায় মারা যায় । কেননা যে ব্যক্তি এখানে মারা যাবে, আমি তার জন্য শাফাআত করব। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৯১৭) 

মদিনায় মৃত্যুবরণ করা মানে হলো, পবিত্র স্থানে ইন্তেকাল করা, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) শায়িত আছেন। যে ব্যক্তি মদিনায় মারা যাবে, তার জন্য নবী (সা.) শাফাআতের সুসংবাদ দিয়েছেন। শাফাআত মানে হলো কিয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুপারিশ, যা একজন মুমিনের মুক্তির উপায়।

হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের মদিনার প্রতি ভালোবাসা এবং সেখানকার বিশেষ মর্যাদার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।

এ কারণে সাহাবায়ে তাবেয়িন ও অলি-অওলিয়াগণ মদিনায় মৃত্যু লাভের দোয়া করেছেন। ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এ বলে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমাকে তোমার পথে শাহাদাত বরণ করার সুযোগ দান কর এবং আমার মৃত্যু তোমার রাসুলের শহরে দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৯০)

মদিনাবাসীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার ভয়াবহতা

নবী (সা.) মদিনার অধিবাসীদের সাথে প্রতারণা বা ষড়যন্ত্র করার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন যে, যে ব্যক্তি তাদের সাথে ষড়যন্ত্র করবে বা তাদের প্রতি প্রতারণা করবে, তার পরিণতি হবে অত্যন্ত খারাপ এবং সেই ব্যক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। নবী (সা.) লবণ ও পানির উদাহরণ দিয়েছেন, যেখানে লবণ পানিতে গলে যায় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়, ঠিক তেমনি সেই ব্যক্তি প্রতারণা বা ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়লে তার সৎ বা ভালো দিক ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সে সমাজ থেকে একেবারে মুছে যাবে। এটি এক ধরনের সতর্কবাণী যে, মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কের বিশ্বাস এবং আন্তরিকতা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে কেউ মদিনাবাসীর সাথে ষড়যন্ত্র বা প্রতারণা করবে, সে লবণ যেভাবে পানিতে গলে যায়, সেভাবে গলে যাবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৭৭)

দাজ্জাল আসতে পারবে না

দাজ্জাল ইসলামের সবচেয়ে বড় ফিতনাগুলোর একটি, যার মাধ্যমে ঈমানদার ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য হবে। মদিনার চারপাশে ফেরেশতারা পাহারায় থাকবেন, তাই দাজ্জাল মদিনায় প্রবেশ করতে পারবে না। এটি মুসলমানদের জন্য মদিনার আশ্রয়স্থল হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ করুণা। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, দাজ্জাল মদিনার দিকে আসবে, তখন সে দেখতে পাবে ফেরেশতারা মদিনাকে পাহারা দিয়ে রেখেছেন। কাজেই দাজ্জাল ও প্লেগ মদিনার কাছে আসতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৪৭৩)পবিত্র শহর

আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) মক্কা নগরীকে ‘হারাম’ বা পবিত্র ঘোষণা করেন। হারাম এলাকায় কিছু নির্দষ্টি কাজ নিষদ্ধি, যেমন গাছ কাটা, শিকার করা, রক্তপাত করা ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনাকে ‘হারাম’ ঘোষণা করেন। এর অর্থ, মদিনার নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে কিছু কাজ নিষদ্ধি, যেমন, গাছপালা কাটা, জীবজন্তু শিকার করা, এর পবিত্রতা নষ্ট করার কোনো কাজ করা। মদিনার হারাম এলাকা হলো এর দুই প্রান্তের কঙ্করময় মাঠের মধ্যবর্তী অঞ্চল। এটি একটি বিশেষ ভূখণ্ড, যা রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে নির্ধারণ করেছেন। উত্তরে, হারা পাহাড়। দক্ষিণে, সাওর পাহাড়। তাই এই নির্দারিত স্থান অন্যান্য শহরের মতো নয়। যা চাইবে তা-ই করতে পারবে না। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই ইবরাহিম (আ.) মক্কার হারাম নির্ধারণ করেছেন আর আমি মাদিনাকে হারাম বলে ঘোষণা করছি এর দুই প্রান্তের কঙ্করময় মাঠের মধ্যবর্তী অংশকে। অতএব, এখানকার কোনো কাঁটাযুক্ত গাছও কর্তন করা যাবে না এবং এখানকার জীবজন্তুও শিকার করা যাবে না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩২০৮)

ময়লা অবর্জনা দূর করে দেয়

জাবের (রা.) বলেন, একজন বেদুইন নবী (সা.) এর কাছে এসে ইসলামের উপর বায়াত গ্রহণ করলো। পরদিন সে জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় নবী (সা.) এর কাছে এসে বলল, আমার (বায়াত) ফিরিয়ে নিন। নবী (সা.) তা প্রত্যাখান করলেন। এভাবে তিনবার হলো। তারপর বললেন, মদিনা কামারের হাপরের মতো, যা তাঁর আবর্জনা ও মরিচাকে দূরীভূত করে এবং খাঁটি ও নির্ভেজালকে পরিচ্ছন্ন করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮৩)

মদিনা আমাদের শিখিয়েছে ভালোবাসা, ঐক্য ও ত্যাগের শিক্ষা। এখানেই ইসলামের সমাজব্যবস্থার প্রথম ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। মদিনা শরিফের প্রতি আমাদের ভালোবাসা যেন আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহর প্রতি ভালোবাসার প্রতিফলন হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *