মানবকল্যাণে ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য ও পুঁজিবাদের স্বরূপ

পয়গাম ডেস্ক :

আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২

ইসলাম শুধুমাত্র আত্নার কল্যাণকামী ধর্মই না বরং ইসলাম গোটা মানবজাতির পার্থিব ও পরলৌকিক  সর্ব বিষয়ে, সুস্পষ্ট ও সর্বাত্বক জীবন ব্যবস্থা। 

আর মানুষের পার্থিব কল্যাণ অনেকটাই নির্ভর করে সুষ্ঠু  অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সমাজ ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে। ইসলাম যেহেতু একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা, সর্ববিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করাই যখন ইসলামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, তাই খুব স্বাভাবিক যে, ইসলামে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এমন কিছু নিয়ম-নীতি থাকবে যা তার মৌল চেতনা ও আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে। ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে যেমনিভাবে আল্লাহর বিধান মেনে চলা আবশ্যক, অনুরূপভাবে অর্থ উপার্জন ও ব্যয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রেও আল্লাহর বিধান মেনে চলা আবশ্যক।  কেননা ইসলামী অর্থব্যবস্থাও ইসলামী জীবন-দর্শন, কৃষ্টি ও সভ্যতার সাথে একই সূত্রে গাঁথা। এর মৌলিক নীতিগুলো পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হতে গৃহিত। ইসলামী অর্থনীতি বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় অর্থব্যবস্থা। মুসলিম দেশ ছাড়াও বহু অমুসলিম দেশ ইসলামী অর্থব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মুসলিম দেশের পাশাপাশি পৃথিবীর অনেক অমুসলিম দেশেও ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যা ইসলামি অর্থনীতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা সম্বলিত।

ইসলামের অর্থনীতির ভিত্তি হলো স্রষ্টাকে ভয় করতঃ সম্পদকে মানুষের মাঝে দ্রুত চালিত করা, কোথাও সঞ্চিত হতে না দেওয়া। পুঁজিবাদ যেখানে বলে সম্পদ খরচ না করে সঞ্চয় করো, সবার সঞ্চয় একত্র করে (ব্যাংকে) পুঞ্জিভূত করো , সেখানে

আল্লাহ্‌ ইরশাদ করছেন____

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡاَحۡبَارِ وَ الرُّهۡبَانِ لَیَاۡکُلُوۡنَ اَمۡوَالَ النَّاسِ بِالۡبَاطِلِ وَ یَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ یَکۡنِزُوۡنَ الذَّهَبَ وَ الۡفِضَّۃَ وَ لَا یُنۡفِقُوۡنَهَا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۙ فَبَشِّرۡهُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ 

হে মু’মিনগণ! অধিকাংশ আহবার এবং রুহবান (ইয়াহুদ ও খৃষ্টানদের আলেম ও ধর্ম যাজক) মানুষের ধন-সম্পদ শারীয়াত বিরুদ্ধ উপায়ে ভক্ষণ করে এবং আল্লাহর পথ হতে বিরত রাখে, আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা, তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক এক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।

(সূরা আত-তাওবাহ,আয়াত-৩৪)

ইসলামের অর্থনীতি পুঁজিবাদী অর্থনীতির ঠিক বিপরীত। পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্লোগান হচ্ছে সঞ্চয় করো আর ইসলাম বলে ব্যয় করো। সমাজতন্ত্রী সাম্যবাদী অর্থনীতি ব্যাক্তিগত মালিকানা নিষিদ্ধ করে জাতির সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে পুঞ্জিভূত করে। ইসলাম সম্পদে ব্যাক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত তো করেই, রাষ্ট্রের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত করতেও নিষেধ করে। কারণ একটা জাতির বা সমগ্র পৃথিবীতে সম্পদ যথাযথভাবে বন্টনের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ব্যয় করা, সঞ্চয় নয়। একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে সম্পদ যত দ্রুত হস্তান্তর হতে থাকবে তত বেশী সংখ্যক লোক সেই সম্পদ থেকে উপকৃত হবে এবং লাভবান হতে থাকবে।

ইসলামী অর্থনীতি ও তার বৈশিষ্ট্য :

ইসলামী  অর্থব্যবস্থা প্রভু প্রদত্ত প্রদত্ত,এবং এর পথ ও পন্থা শরীয়ত নির্দেশিত। যা মানুষের জন্যে সৎ পথে জীবন এবং জীবিকা নির্বাহের সর্বোত্তম মাধ্যম। ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে সম্পদের আমানতদার। এক্ষেত্রে সম্পদ উপার্জন, উৎপাদন ও ভোগে হারাম ও হালালের ব্যবধান নিশ্চিত করা হয়। এ অর্থনীতি সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য যাকাত, ওশর, জিযিয়া ও ছাদাকাতুল ফিৎর ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। সূদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, কালোবাজারী, অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন, চুরি, ডাকাতি, শোষণ, মজুদদারী, যুলুম প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামিক অর্থনীতি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা সম্বলিত অর্থব্যবস্থা। 

ইসলামী অর্থনীতির কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো—

ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক নীতিগুলো পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হতে গৃহিত হয়েছে। মানব সভ্যতা বিধ্বংসী হাতিয়ার সূদ-ঘুষ, জুয়া, লটারীকে তিরোহিত করে ইসলাম মানব কল্যাণকামী ব্যবসা ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। 

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে__

 وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا

 আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন ও সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৫)

 রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَطْيَبُ الْكَسْبِ عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ وَكُلُّ بَيْعٍ مَبْرُورٍ ‘নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয় তাই সর্বোত্তম।

ইসলাম সম্পদের সুষম বণ্টনের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করছেন___

,كَيْ لَا يَكُوْنَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ

 ‘ধনৈশ্বর্য যেন কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়’ (সূরা হাশর,আয়াত-৭)। 

 এ আয়াতের আলোকে ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে আইন ও পলিসির মাধ্যমে সম্পদের বিস্তার ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,إِنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ،  ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করে তাদের গরীবদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।

ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনীতিতে ‘আদল ও ইহসান’ ক্বায়েম করা। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন___

إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ

 নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অন্যায় কাজ ও অবাধ্যতা হ’তে নিষেধ করেন’ (সূরা নাহল, আয়াত-৯০)।

অর্থনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি উৎখাত করা : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা যে সাধারণ নীতি, তা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন____

,الَّذِيْنَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوْا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ ‘

তারা এমন লোক, আমরা যদি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহ’লে তারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে। আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন।

(সূরা হজ্জ, আয়াত -৪১)।

ইসলামী অর্থনীতিতে সব ক্ষেত্রে সুদ হারাম করা হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন,

 الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَذَرُوْا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ، فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوْا فَأْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُوْلِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوْسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُوْنَ وَلَا تُظْلَمُوْنَ-

‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের বকেয়া যা আছে তা ছেড়ে দাও—যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৯)

ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত কল্যাণের যত্ন করা হয়। তাই প্রতিবেশীকে শুফার অধিকারসহ বিভিন্ন হক প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আত্মীয়-স্বজনকে তার প্রাপ্য দেবে এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় কোরো না।’ (সুরা : ইসরা, আয়াত : ২৬)

নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা, ইসলামে প্রত্যেকের সর্বনিম্ন জীবিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই কেউ অক্ষম হলে তার দায়িত্ব ছেলে বা মা-বাবা বা স্বামী বা আত্মীয়-স্বজনকে গ্রহণ করতে হয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন___

وَنُرِيْدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِيْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِيْنَ- 

ধনীদের ধন-সম্পদে আছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ১৯)

ইসলামী অর্থনীতি সৎ চরিত্র দ্বারা বেষ্টিত। তাই একে অন্যকে ধোঁকা, প্রতারণা ও ক্ষতিসাধনের অনুমতি নেই। ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ওপর হাতিয়ার উঠাবে সে আমার দলের নয়। আর যে প্রতারণা করবে সে আমার দলের নয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১০১)

ইসলামী অর্থনীতিতে অপব্যয় বৈধ নয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,অপব্যয় ও অমিতচার করবে না। কেননা আল্লাহ অপব্যয়কারীদের ভালোবাসেন না।’    (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)

করজে হাসানা ইসলামে স্বীকৃত বিষয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘কে আছ যে আল্লাহকে উত্তমভাবে ঋণদান করবে? অনন্তর তিনি তাকে দ্বিগুণ বহুগুণ বর্ধিত করেন এবং আল্লাহ সংকুুচিত বা সচ্ছল করে থাকেন এবং তাঁর দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৪৫)

ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের স্বার্থে স্বাস্থ্যসম্মত দ্রব্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা ও সব অকল্যাণকর, অস্বাস্থ্যকর দ্রব্যের উৎপাদন, আমদানী-রফতানী ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা। 

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করছেন___

,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-  ‘নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, বেদী ও শুভাশুভ নির্ণয়ের তীর সমূহ নাপাক ও শয়তানী কাজ। অতএব তোমরা এসব থেকে বিরত থাকো যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও’ (মায়েদাহ ৫/৯০-৯১)।

মোটকথা, গরীব যেন অনাহারে দিনাতিপাত করে মারা না যায় সেজন্য যাকাত, উশর, খারাজ ইত্যাদির বিধান রাখা হয়েছে । এমনিভাবে ধনবৈষম্য সৃষ্টিকারী শোষণমূলক সুদ, জুয়া, লটারী, কালোবাজারী, মওজুদদারী, ওজনে কম দেওয়া, ভেজাল ইত্যাদি উপার্জনের পন্থাকে হারাম করা হয়েছে । বস্তুত ইসলামি অর্থব্যবস্থায় কোনোরূপ যুলুম, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবকাশ নেই । মদীনার ইসলামি রাষ্ট্রে এর বাস্তবতা দেখা যায় যে আরবের অধিবাসীরা একসময় বৈষম্য ও দারিদ্রের শিকার ছিল, ইসলামি অর্থনীতির স্পর্শে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাতে এমন পরিবর্তন হয়েছিলো যে, যাকাতের অর্থ নেওয়ার মতোও কাউকে পাওয়া যেত না

পুঁজিবাদী অর্থনীতি:

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে আধুনিক পুঁজিবাদী বা ধনতন্ত্রবাদের (Capitalism) উৎপত্তি হয়। পরে ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমগ্র ইউরোপে ধনতন্ত্রের সূত্রপাত হয়। একই সময়ে অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথ ও তাঁর অনুসারীরা এ অর্থনীতির দৃঢ় প্রবক্তা ও সমর্থক হিসাবে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানী, ডেনমার্ক, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালী, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বিদ্যমান।ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ব্যক্তিমালিকানা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর সরকারী হস্তক্ষেপ থাকে না। যে অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণ বা সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা বিদ্যমান এবং সরকারী হস্তক্ষেপ ব্যতীত অবাধ মূল্য ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজার পরিচালিত হয়, তা ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা। এ অর্থব্যবস্থায় উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনরূপ হস্তক্ষেপ থাকে না। একথা স্পষ্ট যে,প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মানব রচিত ।তবে এতে সম্পদই মুখ্য, মানুষ নয়। সময়ের আবর্তনে এ অর্থব্যবস্থা সংশোধন, পরিমার্জন হয়েছে। এ অর্থ ব্যবস্থায় সম্পদ উপার্জন, উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু কোন বিধি-বিধান না থাকায় সমাজে আর্থিক সমতার স্থলে হত-দরিদ্র, নিমণমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং ধনী ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। যা কোন দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে অক্ষম।

২০১৭ সালে জাতিসংঘের তীব্র দারিদ্র্য ও মানবাধিকার বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার  একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স ও জাপান সম্মিলিতভাবে জাতীয় নিরাপত্তা খাতে যত অর্থ ব্যয় করে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী উন্নত বিশ্বের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার ওই সময় বিশদ তথ্য দিয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। সেখানে তিনি আমেরিকার সমাজব্যবস্থাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে অসম সমাজ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, আমেরিকায় অন্তত চার কোটি মানুষ দরিদ্র। সেখানে মৃত্যুহার বাড়ছে এবং সামাজিক অস্থিরতা ও নেশার কবলে পড়ে বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, এই সবকিছুর পেছনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একটি বড় ভূমিকা রাখছে।

(সূত্র:আল-জাজিরা)

মার্কিন পুঁজিবাদ শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বা আশপাশের দেশের মানুষের পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধনের জন্য হুমকি, তা নয়। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও ভোগবাদী সমাজ সম্প্রসারণের কারণে পণ্যের অতি ব্যবহার, অপব্যবহার ও বিষক্রিয়া বাড়ছে। এটি গোটা পৃথিবীকে এমন এক ধ্বংসের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব হবে না। 

১৯৮৯ সালের আগে মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল সুইজি বলেছিলেন, অধিক ভোগ ও উৎপাদন প্রবণতার কারণে গ্রিনহাউস ইফেক্ট বা কার্বন নিঃসরণ ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। পুঁজিবাদ যত বেশি বিকশিত হবে, এই ধারা তত বাড়তে থাকবে। ক্রমেই পৃথিবী ধ্বংসের দিকে যেতে থাকবে।

সূত্র:প্রথম আলো

এক্সট্রিম সিটিজ: দ্য পেরিল অ্যান্ড প্রমিজ অব আরবান লাইফ ইন দ্য এজ অব ক্লাইমেট চেঞ্জ বইয়ের লেখক অ্যাশলে ডওসোন গত ডিসেম্বরে ভারসো বুকস ওয়েবসাইটে লেখা একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘উগ্র পুঁজিবাদ’ এবং ‘পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভকে অপরাধ সাব্যস্ত করার চেষ্টা’ দিয়ে গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। অ্যাশলে ডওসোন বলছেন, ট্রাম্প নিজেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন। এ থেকে তিনি বের হতে পারবেন না। আমেরিকাও বের হতে পারবে না।

পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে এই ধনতান্ত্রিক অস্থির সমাজকে ভাঙতেই হবে। বিশ্বকে জাগতেই হবে।

সারকথা:

একথা স্পষ্ট যে,প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মানব রচিত ।তবে এতে সম্পদই মুখ্য, মানুষ নয়।  এ অর্থ ব্যবস্থায় সম্পদ উপার্জন, উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু কোন বিধি-বিধান না থাকায় সমাজে আর্থিক সমতার স্থলে হত-দরিদ্র, নিমণমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং ধনী ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। যা কোন দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে অক্ষম।

পক্ষান্তরে,  ইসলাম একটি শাশ্বত ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।জীবন অর্থ হলো__ ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন, আর্থিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন- সবকিছুই।ইসলাম ইহকাল ও পরকালের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের সকল কর্মকান্ডের দিক নির্দেশনা ইসলামে বিদ্যমান আছে। আর মানব জীবনে একটি বড় অংশ জুড়ে আছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ইসলামিক অর্থশাস্ত্র প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থশাস্ত্র  থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে, আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়। যা দ্বারা এ বিশ্ব অর্থনীতির ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক উভয়ই কল্যাণকর কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। যে অর্থব্যবস্থায় কুরআন ও সুন্না্হর আলোকে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিভাবে আয়, উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন, মূলধন ও বিনিয়োগ প্রভৃতি পরিচালিত হয়, তাই ইসলামী অর্থব্যবস্থা।

ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা  প্রচলিত অর্থব্যবস্থার মারাত্মক সংকট উত্তরণে একটি সর্বোত্তম অর্থব্যবস্থা হিসাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নীতির সমন্বয় সাধন করে আদর্শ অর্থনীতির প্রবর্তন করেছে এবং করবে।

আহসানুল ইসলাম রাকিব 

শিক্ষার্থী – জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ। mirpur-1 ঢাকা।