যমযম কূপ এবং আবদুল মুত্তালিবের স্বপ্ন 

জুরহুম গোত্রের প্রকৃত বাসস্থান ছিল ইয়েমেন। সেসময় ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় । এ কারণে বনী জুরহুম উপার্জনের সন্ধানে বের হয়। ঘটনাক্রমে চলার পথে হযরত ইসমাঈল (আ) ও তাঁর মাতা হযরত হাজেরা (আ)-এর সাথে যমযম কূপের নিকট সাক্ষাত ঘটে। বনী জুরহুমের জায়গাটি পছন্দ হয় এবং তারা সেখানেই বসবাস শুরু করে। এর কিছুদিন পর ঐ গোত্রের মেয়ের সাথেই ইসমাঈল (আ)-এর বিয়ে হয়। তিনি নবী হিসেবে আমালিকা, জুরহুম ও ইয়েমেনবাসীর প্রতি প্রেরিত হন। একশত ত্রিশ বছর বয়সে ইসমাঈল (আ) ইনতিকাল করেন। হাতীমে তার মাতার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। তার ইনতিকালের পর ওসীয়ত অনুযায়ী তার পুত্র কায়দার কাবাগৃহের মুতাওয়াল্লী হন। এভাবেই ইসমাঈল (আ)-এর বংশ থেকে কাবাগৃহের মুতাওয়াল্লী হতে থাকে। দীর্ঘকাল পরে ইসমাঈল বংশধর ও বনী জুরহুমের মধ্যে মতানৈক্য ও বিবাদের সূচনা হয়। অবশেষে বনী জুরহুম বিজয়ী হয় ও মক্কার কর্তৃত্ব তাদের হাতে এসে যায়। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর জুরহুম শাসকগণ জনগণের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন শুরু করে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ইসমাঈল আ. -এর বংশধরগণ মক্কা ছেড়ে এর চতুষ্পার্শ্বে দূরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। জুরহুমের অন্যায়-অত্যাচার, পাপাচারিতা এবং কাবার অসম্মানকরণ যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন মক্কার চারপাশের সমস্ত আরব গোত্র তাদের সাথে মুকাবিলার উদ্দেশ্যে দণ্ডায়মান হয়। অগত্যা জুরহুমগণকে মক্কা ত্যাগ করে পলায়ন করতে হয়। কিন্তু যখন তারা মক্কা ত্যাগ করা শুরু করে, তখন কা’বার মূল্যবান দ্রব্যাদি যমযম কূপে নিক্ষেপ করে এবং যমযম কূপকে মাটি ভরাট করে এভাবে বন্ধ করে যে যমীন সমান হয়ে যায়। এমনকি যমযমের চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল না ।

বনী জুরহুম মক্কা ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর বনী ইসমাঈল পুনরায় মক্কায় ফিরে আসে এবং বসতি স্থাপন করে। কিন্তু যমযম কূপের প্রতি কেউ নজর দেয় নি। কালের আবর্তনে এর নাম-নিশানা পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়। এমনকি যখন মক্কার শাসনভার ও নেতৃত্ব আবদুল মুত্তালিবের হাতে আসে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় ঐদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় যে, যমযম কূপ যা দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ রয়েছে এবং যার নাম-নিশানা ও মুছে গেছে একে দৃশ্যমান করা হোক। তখন সত্য স্বপ্ন দ্বারা আবদুল মুত্তালিবকে ঐ জায়গা খননের নির্দেশ দেয়া হয়। জায়গার চিহ্ন ও আলামতসমূহও স্বপ্নে দেখিয়ে দেয়া হয়। যেমনটি আবদুল মুত্তালিব বলেছেন :

“আমি হাতীমে ঘুমিয়ে ছিলাম। এমন সময় দেখলাম এক আগন্তুক আমার নিকটে এলো এবং স্বপ্নে আমাকে বললো, ‘কূপটি খনন কর।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন কূপটি ? ততক্ষণে ঐ লোকটি চলে গেলো। পরদিন আবার ঐ জায়গায় ঘুমালাম। স্বপ্নে দেখলাম ঐ ব্যক্তি এসে বললো,’মাযনূনা খনন কর।’ আমি প্রশ্ন করলাম, মাযনূনা কি ? কিন্তু লোকটি চলে গেল। তৃতীয় দিন পুনরায় একই জায়গায় ঘুমালাম। দেখলাম, ঐ ব্যক্তি এসে বললো, ‘পবিত্ৰ স্থান খনন কর।’ আমি শুধালাম, তায়্যেবা কি ? কিন্তু লোকটি চলে গেল। চতুর্থ দিন ঠিক একই জায়গায় স্বপ্নে দেখলাম, ঐ ব্যক্তি এসে বলছে, ‘যমযম খনন কর।’ আমি শুধালাম, যমযম কি? সে বললো, ‘এটি পানির একটি কূপ, যার পানি কখনো নষ্টও হয় না আর কমেও না। অসংখ্য হাজীর পিপাসা নিবৃত্ত করে।”

অতঃপর তিনি সেই স্থানটির কিছু নিদর্শন ও চিহ্ন বলে দিয়ে সেই স্থান খুঁড়তে বলে। এভাবে বারবার স্বপ্নে দেখানো এবং নিদর্শন দেখানোর ফলে আবদুল মুত্তালিবের বিশ্বাস হলো যে এটা সত্য স্বপ্ন।

তিনি কুরায়শদেরকে নিজের স্বপ্নের কথা বলেন এবং এটাও বলেন যে, আমি ঐ জায়গা খুঁড়ে দেখতে চাই। কুরায়শরা এর বিরোধিতা করে। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব এ বিরোধিতার পরোয়া করলেন না, বরং কোদাল ইত্যাদি নিয়ে নিজ পুত্র হারিস সহ ঐ স্থানে পৌঁছলেন এবং চিহ্নিত স্থান খুঁড়তে শুরু করলেন। তিনি নিজে খুঁড়ছিলেন এবং পুত্র হারিস মাটি তুলে দূরে ফেলছিলেন। তিনদিন খোঁড়ার পর এর চিহ্ন দেখা গেল। আবদুল মুত্তালিব খুশিতে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে তাকবীর ধ্বনি দিলেন এবং বললেন : “এটাই ইসমাঈল (আ)-এর কূপ। ”

এরপর আবদুল মুত্তালিব যমযমের নিকটে কিছু হাউজ নির্মাণ করালেন—যাতে হাজীদের পান করানোর জন্য পানি ভরে রাখা হতো। কিছু দুষ্কৃতকারী অপকীর্তি শুরু করলো। তারা রাতে এসে হাউযগুলো নোংরা করে রেখে যেত। যখন প্রভাত হতো, আবদুল মুত্তালিব সেগুলো পরিষ্কার করতেন। অবশেষে অতিষ্ঠ হয়ে এ ব্যাপারে আল্লাহর নিকট দু’আ করেন। তখন স্বপ্নযোগে তাঁকে বলা হয়, তুমি এ দু’আ করো : হে আল্লাহ্ আমি এ যমযমের পানিতে লোককে গোসলের অনুমতি দিই না, শুধু পান করার অনুমতি দিই।”

সকালে উঠেই আবদুল মুত্তালিব এটা ঘোষণা করে দেন। এরপর যে কেউ এ হাউজ নষ্ট করার ইচ্ছা করতো, সেই কঠিন অসুখে পতিত হতো। যখন বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলো, তখন দুষ্কৃতকারীরা আবদুল মুত্তালিবের হাউজের বিরোধিতা করা ছেড়ে দিল। 

আবদুল মুত্তালিবের মান্নত

যমযমের কূপ খননকালে একমাত্র হারিস ছাড়া আবদুল মুত্তালিবের আর কোন সন্তান-সন্তুতি ছিল না। এজন্যে তিনি মান্নত করলেন যে, আল্লাহ যদি আমাকে দশটি পুত্র সন্তান দান করেন, আর তারা যদি যুবক হয়ে আমার বল বৃদ্ধি করে, তা হলে আমি তাদের মধ্য থেকে একজনকে আল্লাহর নামে কুরবানী করবো। আল্লাহ্ তা’আলা যখন তাঁর এ ইচ্ছা পূর্ণ করলেন এবং দশটি পুত্রই যুবক বয়সে উপনীত হলো, তখন একদিন তিনি কাবাঘরের সামনে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় স্বপ্ন দেখেন, “হে আবদুল মুত্তালিব ! এ গৃহের মালিকের উদ্দেশে তোমাব মান্নত পূর্ণ কর।”

আবদুল মুত্তালিব জাগ্রত হয়ে তাঁর সব পুত্রকে ডাকলেন এবং নিজ মান্নতের কথা ও স্বপ্নের কথা তাদেরকে বললেন। তখন সব পুত্র একবাক্যে বললেন, “আপনার মান্নত আপনি পূর্ণ করুন।

আবদুল মুত্তালিব তাঁর সব পুত্রের নামে লটারী করলেন। প্রসঙ্গক্রমে আবদুল্লাহর নামই উঠলো—যাকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। তিনি আবদুল্লাহর হাত ধরে কুরবানীর স্থানের দিকে নিয়ে চললেন, হাতে ছুরিও ছিল। এ অবস্থা দেখে আবদুল্লাহর বোনেরা কান্নাকাটি শুরু করলো। ওদের এক বোন বললো, বাবা আপনি দশটি উট ও আবদুল্লাহর মধ্যে লটারী করুন। যদি দশ উটের পক্ষে লটারী উঠে তা হলে দশটি উট কুরবানী করুন আর আমাদের ভাইকে ছেড়ে দিন। সে সময়ে হত্যার বিনিময়ে দিয়াত হিসেবে দশটি উট নির্ধারণ করা হতো।

লটারী করা হলেও এতে আবদুল্লাহর নামই উঠলো। আবদুল মুত্তালিব দশটি দশটি করে উট বাড়িয়ে লটারী করতেই থাকলেন, কিন্তু প্রতিবারই আবদুল্লাহর নামই উঠতে থাকলো। এমনকি এভাবে যখন একশ’ উট পূর্ণ হলো, তখন আবদুল্লাহর পরিবর্তে উটের নাম উঠলো। আবদুল্লাহ সহ উপস্থিত সবাই ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে উঠলেন। বোনেরা ভাইকে তুলে নিয়ে গেল। আবদুল মুত্তালিব সাফা মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে নিয়ে একশত উট কুরবানী করলেন।

হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন, প্রথমে দিয়াতের পরিমাণ ছিল দশটি উট। আবদুল মুত্তালিবই সর্বপ্রথম কুরাইশ এবং আরব জাহানে একশত উট দিয়্যাত প্রথার প্রচলন করেন। আর নবী করীম (সা)-ও এ প্রথা চালু রাখেন। এ ঘটনার পর থেকে আবদুল্লাহকে ‘যবীহ’ উপাধি দেয়া হয়, আর নবী করীম (সা) কে ইবনুয যাবিহাইন’ অর্থাৎ দু’যবীহ-এর সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

হযরত মুআবিয়া (রা) বলেন, একবার আমরা মহানবী (সা)-এর খিদমতে উপবিষ্ট ছিলাম, ইত্যবসরে এক বেদুঈন এলো এবং নবী (সা)-কে এভাবে সম্বোধন করলো,হে দু’যবীহ-এর পুত্র । এতে তিনি মুচকি হাসলেন। হযরত মুআবিয়া যখন এ হাদীস বর্ণনা সমাপ্ত করলেন, তখন উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে কেউ প্রশ্ন করলো, ঐ দু’যবীহ কোনটি ? তখন হযরত মুআবিয়া (রা) আবদুল্লাহর ঐ ঘটনাটি বর্ণনা করে বললেন, এক তো আবদুল্লাহ আর দ্বিতীয়জন হচ্ছেন হযরত ইসমাঈল (আ)।

আল্লামা যারকানী বলেন, কুরায়শগণ যখন বাৎসরিক দুর্ভিক্ষের মৌসুমে পড়তো তখন আবদুল্লাহকে সাবীর পাহাড়ে নিয়ে যেত এবং তাঁর উসীলায় বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতো । কোন কোন সময় এমনও হয়েছে যে, কুরাইশদের সমস্যা আবদুল মুত্তালিবের উসীলায় সমাধান হয়ে যেত ।