রংপুরে ‘শীতজনিত রোগে’ ছয় দিনে ১৮ শিশুর মৃত্যু

রংপুর বিভাগে জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। ঘন কুয়াশায় গত ৮ দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। ফলে দিন ও রাতে একই রকম শীত অনুভূত হচ্ছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাজনিত নানা রোগে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ এ বিভাগের হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই-তিনগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ শিশু।
গত ৮ দিনে এই হাসপাতালে ১৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে গত ২৪ ঘন্টায় আরো ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন রমেকের বার্ণ ইউনিটের সহকারি অধ্যাপক ডা: শাহীন শাহ।

শিশু বিভাগের দুটি ওয়ার্ডের সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালের তিনতলার ৯ ও ১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ৮০ শয্যার বিপরীতে রোববার সকাল পর্যন্ত ভর্তি আছে তিন শতাধিক শিশু। কোনও কোনও বেডে তিন-চার জন শিশু রোগীকে রাখা হয়েছে। শয্যা সংকটের কারণে অনেক শিশুকে হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডায়রিয়া রোগীদের আলাদা রাখার জন্য ১০টি শয্যা বরাদ্দ আছে। এর বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ৪০ জনের বেশি। দুটি ওয়ার্ডের বেশিরভাগ শিশু জ্বর-সর্দি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এসব ওয়ার্ডে গত ৮ দিনে ১৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের সবাই মারা গেছে ঠান্ডাজনিত রোগে।

সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, মেডিসিন, শিশু ওয়ার্ডসহ সব কটি ওয়ার্ড রোগীতে পরিপূর্ণ। এর মধ্যে শিশু ওয়ার্ডে শয্যা না পেয়ে অধিকাংশ রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একইভাবে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীদের ভিড় দেখা গেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, আন্তবিভাগ ছাড়াও বহির্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছে গড়ে তিন শতাধিক শিশু। শিশু ওয়ার্ডে জায়গা না থাকায় মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শত শত শিশুকে নিয়ে তাদের অভিভাবকরা হাসপাতালের বহির্বিভাগে দীর্ঘ লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন।

বহির্বিভাগের কর্তব্যরত দুজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শয্যা সংকট থাকায় গুরুতর অসুস্থ ছাড়া অন্যদের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

এক বছরের কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে বহির্বিভাগের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন মিঠাপুকুর উপজেলা থেকে আসা আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দুই দিন আগে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয় মেয়েটি। এর মধ্যে ডায়রিয়া শুরু হয়ে যায়। এ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। এখানে এসে দেখি দীর্ঘ লাইন। এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। রোগীদের দীর্ঘ লাইনের কারণে এখনও চিকিৎসক দেখাতে পারিনি। ’

শিশু বিভাগে দিনে কত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে জানতে চাইলে ৯ এবং ১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের কর্তব্যরত দুই চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালের পরিচালকের অনুমতি ছাড়া কোনও তথ্য সাংবাদিকদের দিতে পারবেন না তারা। এ নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানিয়েছেন এই দুই চিকিৎসক।

শীতজনিত রোগে গত ৮ দিনে ১৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছে কিনা জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ ইউনুস আলী বলেন, তীব্র শীতের কারনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে এসব শিশু মারা গেছে।

শীতের তীব্রতা বাড়ায় শিশু ও বয়স্কদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ডা. ইউনুস আলী আরও বলেন, ‘এই সময়ে যে কেউ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এসব রোগ থেকে রেহাই পেতে গরম কাপড় ব্যবহার, যতটা সম্ভব ঠান্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলা জরুরি। শিশুদের ঠান্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখা, সেই সঙ্গে ধুলাবালু থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। শৈত্যপ্রবাহ চলাকালে শিশুদের ঘর থেকে কম বের করতে হবে। ঘরের মধ্যে ঠান্ডা বাতাস যেন না ঢোকে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। ’

রংপুর অঞ্চলের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে রংপুর অঞ্চল। ৮ দিন ধরে সূর্যের দেখা নেই। তীব্র শীতে নগরীতে মানুষের চলাচল কমে গেছে। শপিংমল ও দোকানপাটে ক্রেতা নেই বললেই চলে। শীতের কারণে মানুষ ঘর থেকে কম বের হচ্ছেন। ফলে শ্রমজীবী মানুষের আয় কমে গেছে।

আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, তীব্র শীত আরও দুই-তিন দিন থাকতে পারে। এরপর ১৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি আকাশ মেঘলা থাকবে। বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টির পর আবার তীব্র শীত নামবে। মাসের বাকি সময় থাকতে পারে তীব্র শীত। এ সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চল, সিলেট, যশোর ও চুয়াডাঙ্গাজুড়ে বয়ে যেতে পারে শৈত্যপ্রবাহ।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রোববার সকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। আগামী দুই-তিন দিন শীত বেশি থাকতে পারে। এরপর কিছুটা স্বাভাবিক হবে। ’

এদিকে, শীতে কষ্ট পাচ্ছেন নিম্নআয়ের মানুষজন। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় অনেকে খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ স্বল্পমূল্যে শীতবস্ত্র কিনতে পুরোনো পোশাকের দোকানে ভিড় জমাচ্ছেন। সরকারিভাবে জেলায় এখন পর্যন্ত শীতার্ত মানুষের মাঝে তেমন শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়নি।