অনলাইন ডেস্ক
একজন মুমিনের কাছে রমজান মাসের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো মাস নেই।রমজানের আমলের চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কোনো আমল নেই। বলা যায়, পুরো রমজানটাই মুমিনের জন্য ইবাদতের একটি প্যাকেজ। তাই এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত কীভাবে কাটাতে হবে, তার একটি সুন্দর পরিকল্পনা আগে-ভাগেই গ্রহণ করা উচিত।
রাসুলুল্লাহ (স.) দুই মাস আগে থেকেই অর্থাৎ রজব মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতেন। শাবান মাস আসলে ইবাদতের গতি বাড়িয়ে দিতেন আর বলতেন—‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। ’ (মেশকাত: ১৩৬৯)
রমজানের পরিকল্পনা
১. সামাজিক প্রস্তুতি: রমজানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রতিবেশী ও সমাজের লোকজন একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে রমজানের বিভিন্ন ফজিলত ও ইতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করুন। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গেও একই আলোচনা করুন। সেইসঙ্গে রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
২. পারিবারিক প্রস্তুতি: একটি পারিবারিক রুটিন তৈরি করুন, যাতে রমজানের ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটে। কারো তেলাওয়াত অশুদ্ধ থাকলে, সেটি ঠিক করে নিতে হবে। অনৈসলামিক টিভি প্রোগ্রাম ও অযথা অনলাইন ব্যবহার থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। সিরিয়াল দেখার অভ্যাস থাকলে, আজই ডিসের লাইন কেটে দিন।
৩. গৃহিণীর প্রস্তুতি: সেহেরি ও ইফতার ব্যবস্থাপনায় ইসলামিক নির্দেশনার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। একইসঙ্গে ফরজ-নফল নামাজ, তারাবি, কোরআন তেলাওয়াত ও জিকির-আজকারের জন্য আগেই একটি রুটিন করে নেওয়া উত্তম। সংযমের মাসে গৃহিণীর উচিত অপব্যয় ও অপচয় রোধ করে তা দান-সদকায় ব্যয় করার ক্ষেত্রে স্বামীকে সহযোগিতা করা। পোষাক-আশাক থেকে শুরু করে যেকোনো কিছুর কেনাকাটা যথাসম্ভব আগে-ভাগেই শেষ করা ভালো।
৪. চাকরিজীবীর প্রস্তুতি: ভালো মানুষ হওয়ার ট্রেনিংয়ের মাস রমজান। চাকরিজীবীরা বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ পান রমজানে। সেটা হচ্ছে ফাঁকিবাজি ছাড়া অফিস ডিউটির মাধ্যমে মহান মালিক আল্লাহ তাআলার হক যথাযথ আদায়ের প্রশিক্ষণ। আর সেভাবে নিজেকে অভ্যস্ত করতে চর্চা আগে-ভাগে শুরু করা চাই।
৫. ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি: ব্যবসায়ীরা রমজান মাসে কাজে লাগানোর জন্য এখন থেকেই ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের প্রশিক্ষণ নিন। পণ্য মজুদকরণ, নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া এবং নানা অপকৌশলে মানুষকে ঠকানোর মতো কাজ করে নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কছিন্ন করবেন না একজন মুমিন ব্যবসায়ী। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্য মজুদ রাখল, সে আল্লাহর কাছ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল, আল্লাহ নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে। ’ (মুসনাদে আহমদ: ৮/৪৮১)
পক্ষান্তরে যারা স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করল, এ ব্যবসাই হবে তার ইবাদত। তার উপার্জনে বরকত দেবেন মহান আল্লাহ তাআলা। দেবেন অপ্রত্যাশিত রিজিক। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘খাঁটি ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর পণ্য মজুদদকারী অভিশপ্ত হয়। ’ (ইবনে মাজাহ: ২/৭২৮)
হাশরের ময়দানেও পুরস্কৃত হবেন হালাল ব্যবসায়ীরা। তাকে প্রদান করা হবে নবীগণের সঙ্গী হওয়ার পরম সৌভাগ্য। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীদের হাশরে নবীগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সঙ্গে হাশর হবে। ’ (তিরমিজি: ৩/৫১৫)
৬. গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি: বেহুদা কথা/কাজ করার অভ্যাস থাকলে, যেমন অযথাই ফেসবুক চালানো, বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা, হাসি, ঠাট্টা বা গীবত করা ইত্যাদি বাদ দিয়ে সময়কে আল্লাহর জিকির, কোরআন, হাদিস, ইসলামি সাহিত্য পড়ে কাটানোর অভ্যাস এখন থেকেই তৈরি করা জরুরি।
৭. জ্ঞানার্জনের প্রস্তুতি: নারী-পুরুষ প্রত্যেক মুসলমানের উপরই অন্তত দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান অর্জন ফরজ। সে হিসেবে রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল জেনে নেওয়া আবশ্যক। তাই রমজান শুরু হওয়ার আগেই এ বিষয়ে কিছু বই-পুস্তক কিনে নেওয়া যায়, যাতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও পড়তে পারেন। এছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুরা যেমন- সুরা মুলক, সুরা বাকারার শেষ ২ আয়াত, সুরা কাহাফ, এমনকি ৩০ পারা পুরোটা মুখস্থ করা এখন থেকে শুরু করে দেওয়া যায়।
৮. দান-সদকার প্রস্তুতি: আর্থিক ইবাদতের অপূর্ব সুযোগ রয়েছে রমজানে। এতে বিপুল সওয়াবের ঘোষণা আছে। তাই আত্মীয়-স্বজনের কাছে ইফতারসহ নিত্যপণ্য কিনে পাঠানোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে সে উক্ত রোজাদারের সমান সওয়াব পাবে। তবে এতে সে রোজাদারের সওয়াব একটুও কমবে না। ’ (তিরমিজি: ৩/১৭১)
তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত রমজানকেন্দ্রিক আর্থিক একটা পরিকল্পনা করা। কিছু টাকা জমিয়ে তা দিয়ে অভাবী প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়-স্বজনের ঘরে যেন কিছু ইফতার ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানো যায়। যাদের ওপর জাকাত ফরজ, তাদের আগে থেকেই রমজানকেন্দ্রিক জাকাতের পরিকল্পনা করে নেওয়া উচিত। মা-বোনেরা বা অল্প আয়ের মানুষেরাও নানা উপায়ে দান-সদকা করতে পারেন। যেমন একটি মাটির ব্যাংক বা হাতে তৈরি বক্স গিফট করে, সেখানে টাকা জমিয়ে রমজানে দান করা যায়। আর রমজানে ওমরার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। যারা ওমরা করবেন তারা যথাযথ প্রস্তুতি সম্পন্ন করুন। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে একটি ওমরা আদায় করা একটি ফরজ হজ আদায় করার সমান। ’ (বুখারি: ৩/২২২)
৯. মুসাফিরের প্রস্তুতি: সফর দ্রুত শেষ করা এবং সফর করার থাকলে যথাসম্ভব সেরে নেওয়া উচিত। এতে রমজানে ইবাদতে বিঘ্নতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
১০. নফল নামাজ ও রোজার অনুশীলন: ফরজ নামাজের পাশাপাশি দিন-রাতের বিশেষ সময়গুলোতে নফল নামাজ আদায় করা। নফল নামাজের অভ্যাস গঠনে লম্বা কেরাত এবং লম্বা সেজদার অভ্যাস করা। এছাড়াও প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার এবং আইয়ামে বিজ তথা আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজাসহ অন্যান্য দিন রোজা রেখে রমজানের রোজা রাখার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। তবে, যদি কেউ দুর্বল হওয়ার এবং এতে রমজানে রোজা রাখা কষ্টকর হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে শাবান মাসে রোজা না রাখাই ভালো। সেক্ষেত্রে গত বছরের ভাংতি রোজাগুলোই শুধু রাখুন।
১১. শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি: রমজানে যাদের পরীক্ষা থাকবে অথবা যারা নানা ব্যস্ততার কারণে কোরআন খতম দিতে পারেন না, তারা এখন থেকেই কোরআন খতম শুরু করে দিন এবং প্রতিদিন পড়ুন। রমজানে পড়তে না পারলে এখন কী লাভ-এমনটি ভাবা যাবে না। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলা সবার মনের খবর জানেন।
১২. কোরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন: সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন শেখা এবং মর্মার্থ বুঝে তা অধ্যয়ন রমজান আসার আগেই শুরু করে দিন।
১৩. ইতেকাফের প্রস্তুতি: ইতেকাফের যথাযথ হক আদায়ে পারিবারিক সব প্রস্তুতি রমজানের আগেই সম্পন্ন করে রাখুন। একইসঙ্গে ইতেকাফ বিষয়ক মাসআলা-মাসায়েল জেনে রাখুন।
১৪. শারীরিক প্রস্তুতি: পর্যাপ্ত ইবাদতের জন্য সুস্থ থাকাটা জরুরি। তাই কারো যদি এমন কোনো রোগ থাকে, যা দ্রুত নিরাময়যোগ্য, তারা এখনই চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। এতে রমজানে ইবাদত বন্দেগী সুন্দরভাবে করা যাবে।
১৫. আত্মসমালোচনা: রমজানের প্রস্তুতির জন্য আত্মসমালেচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের খারাপ অভ্যাসগুলো একটি করে ডায়েরিতে লিখে ফেলা দরকার। যাতে রমজানে এক এক করে সেগুলো বর্জন করা যায়।
এভাবে চিন্তা করুন যে, এটিই আপনার জীবনের শেষ রমজান। জান্নাতলাভের সর্বশেষ সুযোগ। তাই কোনোভাবেই এর একটি সেকেন্ডও নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উপরোল্লিখিত প্রস্তুতিগুলো সম্পন্ন করে রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।