অনলাইন ডেস্ক
সারওয়ারে দো আলম, বনী আদমের সর্দার হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা (সা) হস্তী বাহিনীর ঘটনার পঞ্চাশ অথবা পঞ্চান্ন দিন পর ৮ই রবিউল আউয়াল সোমবার মুতাবিক ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে এক সুবহে সাদিকে’ আবূ তালিবের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শুভ জন্মের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ বক্তব্য তো এটাই যে, রাসূল (সা) ১২ই রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবিদদের নিকট প্রসিদ্ধ ও অনুমোদিত বক্তব্য হলো এই যে, রাসূল (সা) ৮ই রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন।
ইরহাস
নবী হিসেবে ঘোষিত হবার পর নবীর দ্বারা যে সমস্ত অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পায়, একে ‘মু’জিযা’ বলে। আর যে সব অলৌকিক ঘটনা নবী জন্মের প্রাক্কালে ঘটে, তাকে ‘ইরহাস’ বলা হয়। ইরহাস অর্থ বুনিয়াদ বা ভিত্তি। যেহেতু এ ধরনের ঘটনা নবী জন্মের সূচনা বা প্রারম্ভিক অবস্থায় ঘটেছে, এজন্যে একে ইরহাস বলা হয়েছে। আবরাহার বায়তুল্লাহ বিরোধী সেনা অভিযান এবং অতঃপর তার ধ্বংস ও বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা মুহররম মাসে সংঘটিত হয়। তখন রাসূল (সা)-এর শুভ জন্মের দিনক্ষণ খুবই সন্নিকটে পৌঁছেছিল। তখন এ ধরনের যত অলৌকিক ঘটনা
প্রকাশিত হয়েছে, সবই ছিল নবী (সা)-এর জন্মের পূর্বাভাস ও আলামত। আবরাহার ঘটনার পঞ্চাশ অথবা পঞ্চান্ন দিন পর এ ধূলির ধরায় রহমতরূপে মহানবী (সা)-এর আবির্ভাব ঘটে।
১. হযরত উসমান ইবন আবুল আস (রা)-এর মাতা ফাতিমা বিনতে আবদুল্লাহ বলেন, হযরত নবী (সা)-এর জন্মের সময় আমি আমিনার কক্ষে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম যে, সমস্ত গৃহ উজ্জ্বল আলোতে ভরে গেছে। দেখলাম আসমানের তারকারাজি নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এমনকি আমার মনে হচ্ছিল যে, না জানি এসব আমার উপর পতিত হয়।
২. হযরত ইরবায ইবনে সারিয়্যা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শুভ জন্মগ্রহণকালীন সময় তাঁর মাতা এক নূর দেখেন, যাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যায়।
৩. হযরত ইয়াকুব ইবন হাসান হযরত আয়েশা (রা) থেকে উত্তম সনদে বর্ণনা করেন যে, জনৈক ইয়াহুদী ব্যবসা উপলক্ষে মক্কায় অবস্থান করতো। যে রাতে রাসূলুল্লাহ (সা) জন্মগ্রহণ করলেন, এরপর ঐ ইয়াহুদী কুরায়শদের এক সভায় উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, এ রাতে কোন ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। কুরাইশরা বললো, আমরা তো জানি না। ইয়াহুদী বললো, একটু খবর নিয়ে দেখ। কেননা আজ রাতে এ উম্মতের নবী জন্মলাভ করেছেন। তাঁর দু’বাহুর মাঝখানে একটি চিহ্ন (মোহরে নবৃওয়াত) আছে। তিনি দু’রাত পর্যন্ত দুধপান করবেন না এজন্যে যে, জনৈক জিন্নগ্রস্ত তাঁর মুখে অঙ্গুলী প্রবেশ করিয়েছিল। লোকজন দ্রুত ঐ সভা থেকে উঠে অনুসন্ধান শুরু করলো। জানা গেল যে, আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিবের একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। ইয়াহুদী বললো, আমাকেও নিয়ে গিয়ে দেখাও। ইয়াহুদী যখন তাঁর দু’বাহুর মাঝখানে ঐ চিহ্ন (মোহরে নবুওয়াত) দেখলো, তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। হুঁশ ফিরে আসার পর সে বললো, নবৃওয়াত বনী ইসরাঈল থেকে চলে গেছে। হে কুরাইশ, আল্লাহর শপথ! এই নবজাতক তোমাদের উপর এমনই আক্রমণ’ করবে, যার খবর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।
৫. ঐ রাতে এ ঘটনাও সংঘটিত হলো যে, পারস্য সম্রাটের প্রাসাদে ভূ-কম্পন হলো এবং প্রাসাদের চৌদ্দটি গম্বুজ ধসে পড়লো আর পারস্যের হাজার বছর ধরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডটি নিভে গেল এবং রাজকীয় অনুষ্ঠানাদি প্রদর্শন বন্ধ করা হলো। অবশেষে উযীরগণ ও রাষ্ট্রের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সভার আয়োজন করা হলো। ঐ দরবারেই এ সংবাদ পৌঁছলো যে, অগ্নিকুণ্ডটি নিতে গেছে। সম্রাটের পেরেশানী এতে বৃদ্ধি পেল। এদিকে এক সভাসদ দাঁড়িয়ে বললো, গত রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, দুর্দান্ত উট আরবী ঘোড়ার দলকে হাঁকিয়ে নিয়ে দজলা নদী পার হয়ে সমগ্র রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্রাট তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা কি? সভাসদ বললো, সম্ভবত আরবের দিক থেকে কোন বিরাটকায় ঘটনা প্রকাশ হতে যাচ্ছে। সম্রাট শান্তি এবং স্বস্তির জন্যে নুমান ইবন মুনযিরের নামে ফরমান পাঠালেন যে, কোন বিজ্ঞ আলিমকে আমার নিকট প্রেরণ কর, যে আমার প্রশ্নাবলীর জবাব দিতে পারবে।
নু’মান ইবন মুনযির তৎকালীন জগতশ্রেষ্ঠ আলিম আবদুল মসীহ গাসসানীকে দরবারে প্রেরণ করলেন। আবদুল মসীহ দরবারে উপস্থিত হলে সম্রাট বললেন, আমি যে বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করতে চাচ্ছি, সে বিষয়ে আপনি কিছু জানেন কি ?
আবদুল মসীহ জবাব দিলেন আপনি প্রশ্ন করুন, যদি আমার জানা থাকে তো বলে দেব, অন্যথায় কোন বিজ্ঞ লোকের নিকট প্রেরণ করবো। বাদশাহ তখন সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করলেন । আবদুল মসীহ বললেন, এর ব্যাখ্যা সম্ভবত আমার মামা সাতীহ দিতে পারবেন, যিনি বর্তমানে সিরিয়ায় বসবাস করছেন।
সম্রাট তাকে নির্দেশ দিলেন যে, আপনি স্বয়ং আপনার মামার কাছে গিয়ে এগুলোর ব্যাখ্যা নিয়ে আসুন। আবদুল মসীহ যখন তাঁর মামা সাতীহ-এর নিকট পৌঁছলেন, তখন তার অন্তিম সময় উপস্থিত। কিন্তু হুঁশ তখনো অবশিষ্ট ছিল। আবদুল মসীহ গিয়ে তাকে সালাম দিলেন এবং কয়েক পংক্তি কবিতা আবৃত্তি করলেন ।
আবদুল মসীহ-এর আবৃত্তি শুনে সাতীহ তার দিকে ফিরলেন এবং বললেন, আবদুল মসীহ দ্রুতগামী উটে চড়ে সাতীহ-এর নিকট এমন সময় পৌঁছলো যখন সে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে । তোমাকে সাসানীয় সম্রাট তার প্রাসাদে ভূমিকম্প, অগ্নিকুণ্ডের নিভে যাওয়া এবং সভাসদের স্বপ্নের কারণে এখানে পাঠিয়েছেন। শক্তিশালী উট আরবীয় ঘোড়াকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং দজলা নদী পার হয়ে সমস্ত শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। হে আবদুল মসীহ ! মনযোগ দিয়ে শোন, যখন আল্লাহর বাণী বেশি বেশি তিলাওয়াত হতে থাকে, যষ্ঠিধারী প্রকাশ পায়, আসমানী প্রশ্বস্ততা প্রকাশ পায়, সাওয়া নহর শুষ্ক হয়ে যায় এবং পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়, তখন সাতীহ-এর জন্য সিরিয়া সিরিয়া থাকবে না; সাসানীয় বংশের কিছু পুরুষ ও কিছু গ্রীলোক কেবল গম্বুজের পরিমাণ বাদশাহী করবে। আর যে বস্তু আগমনকারী, তা সম্ভবত এসে গেছে।
এ কথা বলেই সাতীহ মৃত্যুবরণ করলেন। আবদুল মসীহ ফিরে এলেন এবং সমুদয় বিবরণ সম্রাটকে শোনালেন। সম্রাট তা শুনে বললেন, চৌদ্দজন সম্রাট অতিক্রান্ত হতে তো দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু সময় অতিক্রান্ত হতে আর কত দেরী ? তাদের দশজন সম্রাট তো কেবল চার বছরেই গত হয়েছেন। আর অবশিষ্ট চার সম্রাট তো হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফতকাল পর্যন্ত শেষ হয়েছেন।