লালন-পালন ও দুধপান

শুভ জন্মের পর তিন-চারদিন তাঁর মাতা তাঁকে দুধপান করান। অতঃপর চাচা আবূ লাহাবের আযাদকৃত দাসী সুয়াবা তাঁকে দুধপান করান। সুয়ায়বা যখন তাঁর জন্ম সংবাদ চাচা আবু লাহাবকে শোনান, তখনই আবু লাহাব আনন্দে তাকে মুক্ত করে দেন। তাঁর পূর্বে সুয়ায়রা নবীজীর আপন চাচা হযরত হামযাকে দুধপান করান। এজন্যে হামযা তাঁর দুধভ্রাতা ছিলেন। তাঁর পর সুয়ায়বা আবু সালমাকে দুধপান করান। 

নবী করীম (সা) সুয়ায়বাকে খুবই সম্মান করতেন। হযরত খাদীজা (রা)-এর সাথে তাঁর বিয়ের পর সুয়ায়বা তাঁর খিদমতে হাযির হতেন। হিজরতের পরেও রাসূল (সা) মদীনা থেকেও সুয়ায়বার জন্য উপহার প্রেরণ করতেন। যখন মক্কা মুকাররমা বিজিত হলো, তিনি সুয়ায়বা ও তার পুত্র মাসরুহ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন। যখন জানতে পেলেন যে, তারা দু’জনই মৃত্যুবরণ করেছেন, তখন তাদের নিকটাত্মীয় কাউকে তালাশ করেন, যাতে তার প্রতি অনুগ্রহ করতে সক্ষম হন। জানা গেল, তার কোন আত্মীয়-কুটুম্বও জীবিত নেই।

১. রাবীবাহ আপন স্ত্রীর ঐ কন্যা সন্তানকে বলা হয়, যে স্ত্রীর পূর্বস্বামীর ঔরসজাত।

আবূ লাহাবের মৃত্যুর পর কেউ তাকে স্বপ্ন দেখল যে, সে খুবই দুরবস্থার মধ্যে আছে। জিজ্ঞেস করা হলো, কি অবস্থায় আছো। আবু লাহাব বললো, আমি তোমাদের অপেক্ষা আরামপ্রদ অবস্থা দেখিনি। কেবল এটুকু যে, সুয়ায়বাকে মুক্ত করে দেয়ার

কারণে অঙ্গুলী পরিমাণ পানি পান করতে দেয়া হচ্ছে (বুখারী)। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জন্মের খবর শুনে যে অঙ্গুলীর ইশারায় তাকে মুক্ত করেছি, ঐ পরিমাণ পানিই পান করতে দেয়া হচ্ছে। আল্লামা সুহায়লী (র) বলেন, একবার হযরত আব্বাস (রা) আবু লাহাবকে স্বপ্নে দেখেন যে, সে খুবই খারাপ অবস্থায় আছে এবং বলছে যে, আমি তোমাদের থেকে বিদায়ের পরে কোন শাস্তি দেখি নাই। অবশ্য প্রতি সোমবার শাস্তি লাঘব করা হয়

হালিমা সাদিয়া

সুয়ায়বার পর হালিমা সাদিয়া তাকে দুধপান করান। আরবের প্রচলিত নিয়ম ছিল, সম্ভ্রান্ত বংশীয়রা নিজেদের দুগ্ধপোষ্য সন্তানদের শুরুতেই গ্রামে এ জন্যে প্রেরণ করতেন যাতে গ্রামের নির্মল আলো-বাতাসে শিশু বেড়ে উঠতে পারে, শিশুর ভাষা যাতে শুদ্ধ হয় এবং আরবের আসল তমদ্দুন ও খাঁটি আরবীয় ভাব থেকে বিচ্যুত না হয়। এ প্রথা অনুসারে বনী সা’দের স্ত্রীলোকগণ দুগ্ধপোষ্য শিশুর সন্ধানে প্রতি বছর মক্কায় আগমন করতো।

হালিমা (রা) বলেন, আমি গোত্রের অন্যান্য স্ত্রীলোকের সঙ্গে দুগ্ধপোষ্য শিশুর সন্ধানে মক্কায় আগমন করলাম। আমার সাথে আমার স্বামী এবং নিজের দুগ্ধপোষ্য একটি শিশু ছিল। বাহন হিসেবে সঙ্গে একটি দুর্বল ও কৃশ গর্দভ আর এমন একটি উটনী ছিল যার ওলান থেকে এক ফোঁটা দুধও বের হতো না। ক্ষুধার কারণে রাত্রে আমাদের ঘুম আসতো না। নিজ শিশুটির অবস্থাও এমন ছিল যে, ক্ষুধার তাড়নায় সেও সারারাত কাঁদতো আর চেঁচামেচি করতো। আমার স্তনে এ পরিমাণ দুধও ছিল না, যাতে শিশুটি পরিতৃপ্ত হতে পারে। কোন স্ত্রীলোক এমন ছিল না যে, যার সামনে শিশু নবী (সা)-কে উপস্থিত করা হয়নি। তারা যখনই শুনতো যে, শিশুটি ইয়াতীম, তৎক্ষণাৎ তাঁকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করতো। কারণ যার পিতাই নেই, তার লালন পালনের বিনিময়ে কী-ই বা এমন পাওয়া যাবে। অথচ তখন এটা কারুরই জানা ছিল না যে, তিনি ইয়াতীম নন; বরং ইয়াতীমের লালনকারী এবং ইনি সেই পবিত্র শিশু, যার হাতে রোম ও পারস্য সম্রাটের ধন ভাণ্ডারের চাবিগুলো সোপর্দ করা হবে। পৃথিবীতে যদিও তাঁর কোন ওলী, অভিভাবক ও লালন-পালনের পারিশ্রমিক দেয়ার কেউ নেই, কিন্তু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, যার কুদরতী হাতে আছে পৃথিবী এবং আসমানের অগণিত ভাণ্ডার, তিনিই এই ইয়াতীমের গুলী, অভিভাবক, আর এ শিশুর লালন-পালনকারীকে মুহূর্তে ধারণাতীত পারিশ্রমিকসহ অনেক কিছু দিতে সক্ষম। সব স্ত্রীলোকই দুগ্ধপোষ্য শিশু পেয়ে গেল, কেবল হালিমাই পেলেন না। এদিকে ফিরে যাওয়ার সময় হলো। খালি হাতে ফিরে যাওয়া হালিমার নিকট কষ্টকর মনে হলো। অদৃশ্যলোক থেকে তখন হালিমার অন্তরে ঐ ইয়াতীম শিশুটি গ্রহণের বলিষ্ঠ যুক্তি ও অত্যন্ত আগ্রহের সৃষ্টি হলো।

তিনি গিয়ে স্বামীকে বললেন: “আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই ঐ ইয়াতীম শিশুটির নিকট যাব এবং অবশ্যই তাকে নিয়ে আসব। স্বামী বললেন, যদি তুমি এমনটি কর, তা হলে কোন ক্ষতি নেই। আশা করা যায় আল্লাহ তাকেই আমাদের জন্য কল্যাণ ও বরকতের নিমিত্তে পরিণত করবেন।”

একটি হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন ১৮৮১ বান্দা আমার প্রতি যেরূপ ধারণা পোষণ করে, আমি তার সাথে সে অনুযায়ী আচরণ করি।

” হালিমা এরূপ বরকতের প্রত্যাশা নিয়েই ইয়াতীম শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে আসেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও তাঁর বাসনা অনুযায়ী তাঁর প্রতি বরকতের দরজা উন্মুক্ত করে দিলেন। বনী সাদ-এর অন্যান্য স্ত্রীলোকগণ সৃষ্টের প্রতি আশা পোষণ করে, আর হালিমা স্রষ্টার প্রতি আস্থা স্থাপন করলেন।

হালিমা বললেন, শিশুটিকে মাত্র কোলে নিয়েছি, আর সঙ্গে সঙ্গে আমার শুষ্ক স্তন দুগ্ধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। দুধ এতই বৃদ্ধি পেল যে, তিনি (সা) পান করে পরিতৃপ্ত হলেন এবং তাঁর দুধভ্রাতাও তৃপ্ত হলো। উটনীর দুধ দোহনের সময় দেখা গেল, দুধে উটনীর স্তনও পরিপূর্ণ। আমি এবং আমার স্বামী দুধপান করে পরিতৃপ্ত হলাম। রাত্রিটা খুবই আরামে কাটলো। সকাল হলে স্বামী বলল: “ওহে হালিমা । বুঝে নাও, আল্লাহর কসম, তুমি এক মুবারক সন্তান গ্রহণ করেছো।”

জবাবে হালিমা বললেন: আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই আল্লাহর নিকট এমনটিই আশা করেছিলাম। “ এবার কাফেলার ফিরে যাওয়ার পালা, আর কাফেলার সবাই সওয়ার হয়ে যাত্রা শুরু করেছে। হালিমাও এ ভাগ্যবান শিশুটি নিয়ে ঐ কৃশ ও দুর্বল উটটিতে সওয়ার হলেন—যাকে এর পূর্বে চাবুক মেরে চালাতে হতো, সেটি এখন বিদ্যুৎ গতিসম্পন্ন, কোনক্রমেই থামতে চায় না। কারণ এখন তো সে একজন নবীর বাহনে পরিণত হয়েছে। সঙ্গী স্ত্রীলোকগণ জিজ্ঞেস করলো হালিমা, এটা কি সেই সওয়ারী। আল্লাহর কসম। এখন তো এর মর্যাদাই আলাদা। এভাবেই আমরা বনী সা’দ গোত্রে পৌঁছলাম।

ঐ সময় বনী সা’দ গোত্র এলাকা সবচাইতে অধিক দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকা ছিল। আমার বকরিগুলো যখন চারণভূমি থেকে ফিরে এলো, তখন সেগুলো দুধে পরিপূর্ণ ছিল। আরঅন্যেরগুলো ক্ষুধার্ত ও শুষ্ক স্তন নিয়ে ফিরে এলো, যাতে একফোঁটা দুধও ছিল না। ফলে তারাও নিজেদের রাখালদের ঐ চারণভূমিতে বকরি চরাতে বললো, যেখানে হালিমার বকরীগুলো চরানো হয়। তাদের রাখালরা তাই করলো। এ সত্ত্বেও এমনহলো যে, সন্ধ্যায় হালিমার বকরীগুলো পরিতৃপ্ত ও দুধে ভরপুর অবস্থায় ফিরে আসতো

আর অন্যনেরগুলো আসতো খালি পেটে এবং ওদের স্তনে একফোঁটা দুধও থাকতো না। হালিমা বলেন, আল্লাহ তা’আলা এভাবেই আমাদের প্রতি কল্যাণ ও বরকত প্রদর্শন করতে থাকেন আর আমরা তা প্রত্যক্ষ করতে থাকি। এভাবে যখন দু’বছর পূর্ণ হলো তখন আমি তাঁকে দুধ ছাড়ালাম। যখন দু’বছর পূর্ণ হলো, তখন হালিমা শিশু মুহাম্মদ (সা) কে নিয়ে মক্কায় এলেন। উদ্দেশ্য, মা আমিনার হাতে তাঁর আমানত প্রত্যার্পণ করা। কিন্তু তাঁর কারণে আল্লাহ তা’আলা হালিমাকে যে বরকত ও কল্যাণ দান করেছিলেন, এজন্যে তিনি মা আমিনার কাছে আবদার রাখলেন যে, এ ভাগ্যবান ইয়াতীম শিশুটিকে যেন আরো কিছুদিনের জন্য তার কাছে রাখা হয়। তখন মক্কায় মহামারী দেখা দিয়েছিল। এদিকে হালিমার অসাধারণ আগ্রহে মা আমিনা তাঁর আবেদন মঞ্জুর করলেন এবং আরো কিছুদিন শিশুকে তাঁর কাছে রাখার অনুমতি দিলেন। হালিমা আনন্দচিত্তে তাঁকে নিয়ে বনী সাদ গোত্রে ফিরে এলেন। 

সূত্র: সীরাতুল মুস্তফা সা.

সংকলনে: আহমাদ আল গাজী