সিরিয়ায় প্রথম সফর এবং বাহীরা দরবেশের কাহিনী

তাঁর বয়স বার বছরে পৌঁছেছিল। এ সময় আবূ তালিব কুরায়শ কাফেলার সাথে সিরিয়ায় বাণিজ্য করতে যেতে মনস্থ করলেন। সফরের বিপদাপদের কারণে তাঁকে সাথে নেয়ার ইচ্ছা আবূ তালিবের ছিল না। কিন্তু যাত্রার প্রাক্কালে তাঁর চেহারায় দুঃখের ছায়া দেখতে পেয়ে অবশেষে তাঁকে সাথে নিলেন রওয়ানা হয়ে যখন কাফেলা বসরা শহরের নিকটে পৌঁছলো, সেখানে এক খ্রিস্টান দরবেশ বাস করতেন যার নাম ছিল জারজীন। কিন্তু তিনি বাহীরা নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি শেষ নবীর আগমন সংক্রান্ত আসমানী কিতাবসমূহের বর্ণনা সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত ছিলেন। কাজেই মক্কার এই কাফেলা যখন বাহীরা দরবেশের আস্তানার পাশে অবতরণ করলো, তখন তিনি রাসূল (সা)-এর চেহারা মুবারক দেখামাত্র তাঁকে চিনে ফেললেন যে, তিনিই সেই শেষ নবী, যার সম্পর্কে পূর্বতন আসমানী কিতাবসমূহে বলা হয়েছে। তিনি এসে তাঁর হাত ধরলেন  হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা) থেকে বর্ণিত যে, একবার আবূ তালিব কুরায়শ নেতৃবৃন্দের সাথে সিরিয়ায় গেলেন। সিরিয়ায় যেখানে তিনি অবতরণ করলেন, সেখানে এক দরবেশ বাস করতেন। ঐ দরবেশের আস্তানার পাশ দিয়ে এর পূর্বেও তারা একাধিকবার গমন করেছিলেন, কিন্তু দরবেশ কখনো তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করতেন না। কিন্তু এবারে যখন সেখানে কুরায়শের বাণিজ্য কাফেলা অবতরণ করলো, দরবেশ নিয়ম- নীতিবহির্ভূতভাবে নিজের আস্তানা থেকে বের হলেন এবং কাফেলার ব্যক্তিবর্গের প্রতি এক এক করে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত হুযূর (সা)-এর হাত ধরলেন এবং বললেন : “তিনিই বিশ্বনেতা, তিনি বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, যাঁকে আল্লাহ গোটা বিশ্বের জন্যে রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন।” কুরায়শ নেতৃবৃন্দ দরবেশকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা আপনি কিভাবে বুঝলেন ? তখন দরবেশ বললেন, যখন আপনারা নিজ অবস্থান থেকে বের হলেন, তখন পরিপার্শ্বের গাছপালা, তরুলতা ইত্যাদি নতশীরে তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। আর এসব বস্তু কেবল নবীদেরকেই এভাবে সম্মান জানায়। এছাড়া মোহরে নবৃওয়াত দেখেও তাঁকে চেনা যায়, যা তাঁর দু’বাহুর মাঝখানে একটি আপেলের মত দৃশ্যমান।

দরবেশ এটুকু বলেই প্রস্থান করলেন এবং কেবল তাঁরই সৌজন্যে সমগ্র কাফেলার জন্য খাদ্য প্রস্তুত করলেন। খাবার গ্রহণের জন্য সবাই উপস্থিত হলে এতে তিনি (সা) ছিলেন না। দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন তিনি কোথায় এবং জানতে পেলেন যে তিনি উট চরাতে গিয়েছেন। তখন লোক পাঠিয়ে তাঁকে ডেকে আনলেন। চারণভূমি থেকে আসার সময় একটি মেঘখণ্ড তাঁকে ছায়া দিয়ে আসছিল। তিনি কাফেলার নিকট পৌঁছে দেখতে পেলেন, সেখানে তাঁর পৌঁছার আগেই বৃক্ষের ছায়ার সবটুকুর নিচে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। আর কোন জায়গা ছায়ার নিচে অবশিষ্ট নেই। হযরত (সা) একপাশে বসে পড়লেন। তিনি বসামাত্রই গাছের ছায়া তাঁর দিকে প্রসারিত হলো। দরবেশ সবাইকে বললেন, আপনারা বৃক্ষের ছায়ার প্রতি লক্ষ্য করে দেখুন, কিভাবে ছায়াটি সম্প্রসারিত হলো। এরপর দরবেশ দাঁড়িয়ে কসম করে বললেন, আপনারা কখনই তাঁকে রোমের দিকে নিয়ে যাবেন না। রোমবাসীরা তাঁকে দেখলে, তাঁর গুণাবলী ও লক্ষণসমূহ দেখে তাঁকে চিনে ফেলবে এবং তাঁকে হত্যা করবে। কথাবার্তা বলার ফাঁকেই দরবেশ হঠাৎ দেখলেন, একদিক থেকে সাতজন রোমবাসী কোনকিছুর সন্ধানে এদিকেই আসছে। দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি উদ্দেশে বের হয়েছ? জবাবে তারা বললো, আমরা ঐ নবীর সন্ধানে বের হয়েছি, তাওরাত এবং ইনজিলে যাঁর আগমনের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে এবং যিনি এ মাসেই এদিকে সফরে আসার কথা। এজন্যে চারদিকেই আমরা লোক প্রেরণ করেছি। দরবেশ বললেন, তা হলে তোমরা বল যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যা ইচ্ছা করেন তা কি কখনও কেউ রুখতে পারে? রোমবাসী নাগরিকরা বলল, না। এরপর দরবেশের নিকট তারা ওয়াদা করলো, আমরা আর ঐ নবীর সন্ধানে ইচ্ছুক নই। অতঃপর ঐ সাত ব্যক্তি বাহীরা দরবেশের নিকটই রয়ে গেল। কেননা তারা যে উদ্দেশে বের হয়েছিল, এখানেই সে উদ্দেশ বদলে গেল। এখান থেকে ফিরে পেলে তাদের উপর উল্টা ফল ফলতে পারে আশঙ্কায় তারা না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি নেয়। দরবেশ কুরাইশ কাফেলাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে এ বালকটির অভিভাবক কে? লোকেরা আবু তালিবের দিকে ইঙ্গিত করলো। দরবেশ আবূ তালিবকে বললেন, আপনি তাঁকে শীঘ্রই ফেরত পাঠিয়ে দিন। আবূ তালিব তাঁকে আবূ বকর ও বিলালের সাথে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন। দরবেশ তাঁদের পথের খাবার হিসেবে রুটি ও যয়তুন তেল দিয়ে দিলেন।

সূত্র: সীরাতুল মুস্তফা সা.

সংকলনে: আহমাদ আল গাজী