হযরত আরকামের গৃহে মুসলমানদের জমায়েত

যখন এভাবে আস্তে আস্তে জনগণ ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করলেন, তখন মুসলমানদের একটি ছোট দল তৈরি হলো। সবাই তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, হযরত আরকাম (রা)-এর গৃহে একত্রিত হওয়া যাক। হযরত আরকাম প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে সপ্তম অথবা দশম অবস্থানে ছিলেন আর তাঁর গৃহটি ছিল সাফা পাহাড়ে। হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানগণ সেখানে একত্রিত হতেন। হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের পর তাঁরা যেখানে ইচ্ছা একত্রিত হতেন।

দাওয়াতের ঘোষণা

তিন বৎসর পর্যন্ত হযরত (সা) গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকলেন এবং মানুষ ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকলো। তিন বৎসর পর এ নির্দেশ নাযিল হলো যে, প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিন ।

অতএব তিনি সাফা পাহাড়ে উঠলেন এবং কুরায়শ সম্প্রদায়ের প্রত্যেককে নাম ধরে ডাকলেন। যখন সবাই একত্রিত হলো, তিনি ইরশাদ করলেন, যদি আমি তোমাদের এ খবর দেই যে, পাহাড়ের অপর প্রাপ্তে একদল সৈন্য জমায়েত হয়েছে যারা তোমাদের উপর হামলার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে কি তা সত্য মনে করবে ? সবাই একবাক্যে বলল, অবশ্যই; কেননা আমরা তো আপনার মধ্যে সত্যবাদিতা ছাড়া কিছু দেখিনি। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে এক কঠিন শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করছি (অর্থাৎ মূর্তিপূজার শিরকী গুনাহর শান্তি। তোমাদের ইলআহ্ শুধু একজন ইলাহুকুম ইলাহুল ওয়াহিদ)। আবু লাহাব তখন গোসসায় জাবলে উঠলো; বলল, তোমার ধ্বংস হোক, তুমি কি এজন্যে আমাদেরকে একত্রিত করেছ? এ প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ রাগান্বিত হয়ে সাথে সাথে এ মর্মে ওহী পাঠালেন যে, “তাব্বাত ইয়াদা আবি লাহাবি ওয়া ডাক… যার অর্থ আবু লাহাব ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক.. (শেষ পর্যন্ত) সূরা নাযিল হয়

ইসলামের দাওয়াত এবং ভোজের নিমন্ত্রণ

হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, যখন

(আর সর্বপ্রথম আপনার নিকটাত্মীয়দের কুফর ও শিরকের শাস্তি সম্পর্কে হুঁশিয়ার ও ভীতি প্রদর্শন করুন) আয়াতটি নাযিল হলো, তখন হযরত (সা) আমাকে বললেন, এক সা শস্য, ছাগলের একটি রান ও এক পেয়ালা দুধ সংগ্রহ কর এবং এরপর আবদুল মুত্তালিবের সন্তানদের একত্র কর। আমি তাঁর নির্দেশ পালন করি। কমবেশি চল্লিশ ব্যক্তি একত্রিত হলো; যাদের মধ্যে তাঁর পিতৃব্য আবূ তালিব, হামযা, আব্বাস এবং আবূ লাহারও শামিল ছিলেন। তিনি এক পেয়ালা গোশত তাঁর পবিত চিরে ঐ পেয়ালাতেই রাখলেন এবং বললেন, আল্লাহর নাম নিয়ে সক করুন। ঐ এক পেয়ালা গোশতে সবাই খেয়ে তৃপ্ত হলেন। এরপরও কিছু আসলে ঐ খাবার এতটুকু ছিল যে, একজনের জন্য তা যথেষ্ট হতে পারতো। এরপর আমাকে হুকুম দিলেন, দুধের পেয়ালা আন এবং সবাইকে পান করাও। ঐ এক পেয়ালা দুধে সবাই পরিতৃপ্ত হলেন অথচ এক পেয়ালা দুধ এত অধিক পরিমাণ ছিল না। এক পেয়ালা দুধ তো একজনই খেতে পারে। যা হোক, এভাবে চল্লিশ ব্যক্তি যখন খাওয়া শেষ করলেন, তখন তিনি (সা) কিছু বলার ইচ্ছা করলেন, আবু লাহাব তখন বলে উঠলো, লোক সকল! উঠে পড়, মুহম্মদ তো আজ তোমাদের খাবারের উপর জাদু করেছে। এমন জাদু, যা এর আগে কখনো দেখিইনি। এ কথা বলাতে লোকজন উঠে পড়তে শুরু করলো আর তাঁর কিছু বলার সুযোগই হলো না। দ্বিতীয় দিন তিনি একইভাবে হযরত আলীকে খাবারের আয়োজন করতে নির্দেশ দিলেন। এমনিভাবে দ্বিতীয় দিনও লোকজন একত্রিত হলো। আহার শেষে তিনি (সা) বললেন, যে বস্তুটি আমি এবার আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি, এর চেয়ে উত্তম কোন বস্তু এর পূর্বে কোন ব্যক্তি নিজ সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থাপন করেনি। আমি আপনাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সংবাদ নিয়ে এসেছি।

একবার কুরায়শের কয়েক ব্যক্তি একত্র হয়ে আবূ তালিবের কাছে এসে বলল, আপনার ভাইপো আমাদের প্রতিমাগুলোকে মন্দ বলে, এগুলোর সমালোচনা করে,

আমাদের ধর্মকে খারাপ আর আমাদেরকে আহমক, মূর্খ এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পথভ্রষ্ট বলছে। আপনি হয় তাকে নিষেধ করুন অথবা তার ও আমাদের মধ্যে কিছু হলে আপনি আসবেন না, আমরা নিজেরাই বোঝাপড়া করব। আবূ তালিব তাদেরকে সুসম্পর্ক ও নম্রতা দিয়ে বশীভূত করেন। আর হযরত (সা) একইভাবে তাওহীদের

দাওয়াত এবং কুফর ও শিরকের বিরুদ্ধাচরণে মশগুল থাকলেন। এতে আবু লাহাব এবং তার সমচিন্তার লোকদের হিংসা ও শত্রুতার আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করল । ঐসব লোকের একটি দল দ্বিতীয়বার আবূ তালিবের নিকট এলো আপনার শরাফত ও মর্যাদা আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য, কিন্তু নিজেদের প্র অভিসম্পাত আর পূর্বপুরুষদেরকে আহমক ও মূর্খ বলার বিষয়টি আমরা সহ্য করতে পারি না। আপনি আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে বারণ করুন, অন্যথায় লড়াই করে আমাদের কোন এক পক্ষ শেষ হয়ে যাবে। এ কথা বলেই তারা চলে গেল। পুরো খান্দান ও সম্প্রদায়ের বিরোধিতা ও শত্রুতা আবূ তালিবের মনকে প্রভাবিত করলো।

যখন হযরত (সা) তাশরীফ আনলেন। আবূ তালিব বললেন, হে প্রিয় বৎস! তোমার সম্প্রদায়ের লোকজন আমার কাছে এসেছিল এবং এইসব বলে গেল। কাজেই তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ কর এবং নিজের প্রতিও একটু নজর দাও। আমার উপর সাধ্যের অতীত বোঝা চাপিও না। আবূ তালিবের এ ধরনের বাক্যালাপে রাসূল (সা)-এর মনে এ ধারণার উদয় হলো যে, হয়ত আবূ তালিব আমার সাহায্য-সহায়তা থেকে বিরত থাকতে চাইছেন। কাজেই তিনি ছলছল নেত্রে ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন, চাচাজান! আল্লাহর কসম, যদি এরা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্রও এনে দেয় এবং বলে এ কাজ ছেড়ে দাও, তবুও আমি কখনো তা ছাড়তে পারবো না; যতক্ষণ না আল্লাহ আমার দীনকে বিজয়ী করেন অথবা আমি ধ্বংস হয়ে যাই। এ কথা বলে তিনি কেঁদে ফেলেন এবং উঠে চলে যেতে লাগলেন। আবূ তালিব উচ্চৈস্বরে বললেন, ওহে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র! তোমার যা খুশি কর, আমি কখনই তোমাকে শত্রুর হাতে তুলে দেব না।

সূত্র: সীরাতুল মুস্তফা সা.

সংকলনে: আহমাদ আল গাজী