হযরত খাদীজার সান্ত্বনা এবং ওরাকা ইবনে নাওফলের সঙ্গে সাক্ষাৎ 

এরপর তিনি গৃহে ফিরে আসেন। এ অবস্থায় যে, শংকায় তার শরীর এর করে কাঁপছিল। এসেই তিনি হযরত খাদীজাকে বললেন, “আমাকে বস্ত্রাবৃত কর, আমাকে বস্ত্রাবৃত কর।” কিছুক্ষণ পর যখন তাঁর ভীতি ও বিমূঢ়তার ভাব কেটে গেল, তখন তিনি হযরত খাদীজার সামনে সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করলেন এবং বললেন, আমার আশংকা হচ্ছে যে, আমার প্রাণ বায়ু বেরিয়ে না যায়!

হযরত খাদীজাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন এবং বললেন যে, আমার জীবনের আশংকা করছি। হযরত খাদীজা বললেন, এটা আপনার জন্য সুসংবাদ, আপনি কখনই ভীত হবেন না। 

আল্লাহর কসম! তিনি আপনাকে কখনই অপসন্দ করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেন, আপনার এ ঔদার্য খুবই যুক্তিযুক্ত, আপনি সর্বদা সত্য কথা বলেন, লোকদের বোঝা বহন করেন, অর্থাৎ অন্যের দায়িত্ব নিজের মাথায় বহন করেন। অনাথ অসহায়ের খোঁজ-খবর নেন, আপনি আমানতদার, জনগণের আমানত রক্ষা করেন, মেহমানকে আহার্যদানের হক আদায় করেন, আপনি সত্যের পক্ষে সর্বদা রক্ষক ও সাহায্যকারী।

হযরত খাদীজা আরো বললেন, কল্যাণ হোক এবং আপনার জন্য সুসংবাদ। আল্লাহর শপথ! তিনি আপনার জন্য কল্যাণই করবেন। যে সৌভাগ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার নিকট এসেছে, তা গ্রহণ করুন, নিঃসন্দেহে তা সত্য। আবার বলছি, আপনার জন্য সুসংবাদ, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর সত্যিকারের রসূল।

হযরত খাদীজা একাকী তাঁর চাচাত ভাই ওরাকা ইবন নাওফলের নিকট গেলেন, যিনি তাওরাত ও ইঞ্জিলের বড় আলিম ছিলেন। তিনি সুরিয়ানী ভাষা থেকে আরবীতে ইঞ্জিল অনুবাদ করেছিলেন এবং জাহিলিয়াতের যুগে মূর্তি পূজায় বিতৃষ্ণ হয়ে খ্রিস্টধর্ম

গ্রহণ করেছিলেন। তখন তিনি খুবই বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। হযরত খাদীজা সমুদয় ঘটনা তাঁকে খুলে বললেন। শুনে ওরাকা বললেন : “তুমি যদি সত্যি বলে থাক, তা হলে অবশ্যই তিনি নামূস’ (ফেরেশতা) যিনি ঈসা (আ)-এর নিকট আসতেন।” এরপর হযরত খাদীজা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সাথে নিয়ে ওরাকার নিকটে গেলেন এবং বললেন, ভাইজান! আপনার ভাতিজার’ অবস্থা তার মুখ থেকেই শুনুন। ওরাকা তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, ভাতিজা ! বল দেখি, তুমি কি দেখেছ ? হযরত (সা) সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করলেন। ওরাকা যখন তাঁর সমস্ত কথা শুনলেন, তাতে তাঁর মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মালো যে, তিনি যা কিছু বলেছেন, সবই সত্য। ওরাকা তাঁর কথা বুঝতে পারলেন এবং তা সমর্থন করলেন ওরাকা তাঁর সকল অবস্থা শুনে বললেন, আগন্তুক হলেন ঐ নামূস (ফেরেশতা), যিনি মূসা (আ)-এর নিকট আসতেন। হায়, তোমার পয়গাম্বরীর সময় যদি আমি শক্তিমান থাকতাম এবং অন্ধ না হতাম ! যখন তোমার সম্প্রদায় তোমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে, কিংবা অন্তত জীবিতও যদি থাকতাম । তিনি (সা) খুবই আশ্চর্য হয়ে বললেন, ওরা কি আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে ? ওরাকা বললেন, কেবল তুমিই নও, এ পৃথিবীতে যিনিই আল্লাহর বাণী নিয়ে এসেছেন, মানুষ তাঁরই সাথে শত্রুতা করেছে। যদি আমি ঐ পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে অবশ্যই তোমাকে সাধ্যমত সাহায্য করবো। কিন্তু এরপর ওরাকা বেশিদিন বেঁচে ছিলেন না। 

ফিরিশতাকে ঈসা (আ)-এর নামূস (তা)-এর সাথে সাদৃশ্য বর্ণনা করেছেন। এক বর্ণনায় আছে, নবী (সা) প্রত্যাবর্তনকালে ওরাকা তাঁর মস্তকে চুম্বন করেন। তিনি গৃহে ফিরে এলেন এবং কয়েকদিন তাঁর প্রতি ওহী নাযিল বন্ধ রাখা হয় যাতে তাঁর ভীতি ও কষ্ট দূর হয়ে যায় এবং পরবর্তী ওহী আগমনের উৎসাহ ও অপেক্ষা করার আগ্রহ তাঁর অন্তরে জাগ্রত হয়।

“প্রত্যেক সাধকের অন্তরে হাজারো চিন্তা-ভাবনা থাকে, নিশ্চিন্ত জীবন কমই আছে। বিরহ অপেক্ষা বড় মুসীবত কিছুই নেই, কোনভাবে মরে যাওয়াও যেন এর চেয়ে উত্তম।” কিন্তু তিনি যখনই এরূপ চিন্তা করতেন তখনই জিবরাঈল (আ) দৃশ্যমান হতেন এবং বলতেন : “হে মুহাম্মদ! সত্যিই আপনি আল্লাহর রাসূল।” এ কথা শুনে তাঁর অন্তরে স্বস্তি ফিরে আসতো।

একবার হযরত খাদীজা (রা) নবী (সা)-কে বললেন, আবার যখন ঐ নামূস আসবেন, সম্ভব হলে আমাকে অবশ্যই খবর দেবেন। কাজেই এরপর যখন হযরত জিবরাঈল (আ) তাঁর কাছে এলেন, তিনি ওয়াদা মুতাবিক হযরত খাদীজা (রা)-কে খবর দিলেন। খাদীজা (রা) নবীজী (সা)-কে বললেন, আপনি আমার আলিঙ্গনাবদ্ধ হন। তিনি আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন। এমতাবস্থায় হযরত খাদীজা মাথার কাপড় খুলে ফেলেন এবং জিজ্ঞেস করেন, এখনও কি আপনি ফিরিশতাকে দেখতে পাচ্ছেন ? নবী (সা) বললেন, না। তখন খাদীজা (রা) বললেন, আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর শপথ, তিনি ফেরেশতা, শয়তান নয়। এ বর্ণনা মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ইসমাঈল ইবন হাকিম থেকে ‘মুরসাল’ সনদে রিওয়ায়াত করেন। সীরাতে ইবন হিশামের অপর এক বর্ণনায় আছে, খাদীজা বললেন, আপনার জন্য সুসংবাদ, তিনি অবশ্যই ফেরেশতা, শয়তান হলে (আমার ঘোমটা খুলে ফেলাতে) লজ্জাবোধ করতো না।

সূত্র: সীরাতুল মুস্তফা সা.

সংকলনে: আহমাদ আল গাজী