
মূলধন ঘাটতিতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ করা মার্চ মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে ২৩টি ব্যাংক বর্তমানে মারাত্মক মূলধন ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। এই ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ২৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে বিতরণ করা বিপুল পরিমাণ ঋণের একটি বড় অংশ এখন খেলাপি হয়ে গেছে। এসব অনাদায়ী ঋণই মূলধন ঘাটতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে শুধুমাত্র এসব ব্যাংক নয়, পুরো ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত যে ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, অগ্রণী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রত্যেকটির ঘাটতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকার মধ্যে। এ ছাড়া এবি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, আইএফআইসি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক এবং বিদেশি হাবিব ব্যাংকও তালিকায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বিদায়ের পর ব্যাংক খাতে জমে থাকা আর্থিক দুর্বলতা ও ঝুঁকিগুলো এখন একের পর এক সামনে আসছে। অতীতে রাজনৈতিক প্রভাব ও ছত্রচ্ছায়ায় পরিচালিত অনেক ব্যাংকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। নতুন প্রশাসনের অধীনে সেই অনিয়মের চিত্র আরও পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। রাজনৈতিক সুবিধাভোগের সুযোগে দীর্ঘদিন যাবৎ চাপা থাকা দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও খেলাপি সংস্কৃতি এখন পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। জানা গেছে, মূলধন ঘাটতিতে থাকা পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও ১১টি ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য মূল্যায়নের কাজ চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, যেসব ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে, তাদের কাছ থেকে একটি বাস্তবসম্মত পুনর্গঠন পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। এমন পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ব্যাংক খাতের আরেকটি গুরুতর সংকট হয়ে উঠেছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। শুধু তিন মাসের ব্যবধানে-২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত- খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক প্রকার রেকর্ড।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক খাত বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অবস্থা শুধু কিছু ব্যাংকের আর্থিক দুর্বলতার প্রতিফলন নয়, বরং পুরো ব্যাংকিং খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা, স্বচ্ছতার অভাব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির দুর্বলতাকেও সামনে এনেছে। তাদের মতে, অনেক ব্যাংক বারবার সময় পেলেও মূলধন ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিল তদারকি, জবাবদিহির ঘাটতি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অনুপস্থিতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এখনই যদি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে দেশের ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা, কার্যকর তদারকি এবং কঠোর খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কেবল এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে মত তাদের।