রাজশাহীতে কৃষকের ৬০ বিঘা কৃষি জমি দখল করে যুবদল নেতার পুকুর খনন

রাজশাহীর বাগমারার খোর্দ্দকৌর এলাকার নিমাই বিলের ৬০ বিঘা ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুল কয়েকজন যুবদল নেতা এবং তার সহযোগীদের নিয়ে কৃষকের জমিতে জোরপূর্বক পুকুর খনন করেছেন।

এ ঘটনায় টুটুলসহ ১১ জন তার সহযোগীর নামে আদালতে মামলা করা হয়েছে। খোর্দ্দকৌর গ্রামের আফাজ উদ্দিন প্রামাণিক নামের এক কৃষক গত ১৮ মার্চ রাজশাহী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রট আমলি আদালতে মামলা করেছেন। এছাড়া হুমকির অভিযোগে পুকুর খনন চক্রের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন কৃষকরা।

একই সঙ্গে পুকুর খনন বন্ধে জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসি বরাবর স্মারকলিপি দেয় কৃষকরা। এছাড়াও রাজশাহীর পরিবেশবাদী একটি সংগঠনের পক্ষ থেকেও স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। এর পরও বন্ধ হয়নি অবৈধভাবে পুকুর খনন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন যুবদল নেতা রেজাউল করিম টুটুল।

তার দাবি, পুকুর খননের সঙ্গে আমার ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নেই। আমি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইব। এলাকায় আমি জনপ্রিয়। একারণে ভয় পেয়ে দলের একটি অংশ আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। পুকুর খননের সঙ্গে যদি যুবদলের অন্য কেউ জড়িত থাকে জেলা কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আমি নিজেই তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।
তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, নিমাই বিলের ২৫ জন কৃষকের প্রায় ৬০ বিঘা কৃষি জমিতে ইতোমধ্যে পুকুর খননের কাজ প্রায় শেষ। তাদের কেউই জমিতে পুকুর খননের অনুমতি দেননি। তারপরও জোরপূর্বক পুকুর খনন করা হয়েছে। বাধা দেওয়ায় যুবদলের নেতাকর্মীরা হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। এর ফলে ভুক্তভোগী কৃষক এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। তারা জমি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন।

এদিকে, গত ১৮ মার্চ আফাজ উদ্দিন প্রামাণিক নামের এক কৃষকের আদালতে দায়ের করা মামলায় যুবদল নেতা রেজাউল করিম টুটুলকে প্রধান আসামি করেছেন। অন্য আসামীদের মধ্যে রয়েছেন, বাগমারার তাহেরপুর পৌরসভা যুবদলের আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আরিফ, তাহেরপুর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের নেতা শরিফুজ্জামান শরিফ, ভবানীগঞ্জ পৌরসভা যুবদলের সাবেক সভাপতি মো. মানিক, যুবদল নেতা সাহাদাত, ইমন আহমেদ, সাদ্দাম হোসেন, খোরশেদ আলম, জাহাঙ্গীর হোসেন, রাসেল রানা ও খুরশেদ। এছাড়াও আরও ১২ জনকে অজ্ঞাত আসামী করা হয়েছে এ

মামলার আরজির বরাত দিয়ে বাদীর আইনজীবী হোসেন আলী পিয়ারা বলেন, মামলার আসামিরা গত ফেব্রুয়ারি থেকে আফাজ উদ্দিন প্রামাণিকের ৯৩ শতক জমিতে পুকুর খনন শুরু করেন। বাধা দিতে গেলে তারা আফাজের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন। এ মামলার বাদীসহ অন্য ভুক্তভোগী কৃষকেরা বাগমারা থানা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) শরণাপন্ন হলেও প্রতিকার পাননি। তাই এ মামলা করা হয়। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন।

জোরপূর্বক জমিতে পুকুর খননের ব্যাপারে গত ৮ মার্চ আমজাদ হোসেন প্রামাণিক নামের আরেক কৃষক বাগমারা থানায় একটি জিডি করেন। এতে উল্লেখ করা হয়, সম্প্রতি যুবদলের ওই নেতারা জোরপূর্বক তার জমিতে পুকুর খনন শুরু করেন। খবর পেয়ে তিনি গিয়ে বাধা দেন। এ কারণে গত ৬ মার্চ সকালে যুবদল নেতারা তার বাড়ি গিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এতে তিনি চরম নিরাপত্তাহীয় রয়েছেন।

ভুক্তভোগী আমজাদ বলেন, আমার জমিতে পুকুর কাটছে, অথচ আমিই জানি না। আমার এটা ধানি জমি। এই জমির ধানই আমরা সারাবছর খাই। ওই জমি হারালে তো আমি বিপদে পড়ে যাব। চালের অভাবে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সমস্যায় পড়ব।

অপরদিকে, পুকুর খননের ব্যাপারে গত ৮ মার্চ ঈশিতা ইয়াসমিন নামের আরেক নারী থানায় জিডি করেছেন। তার অভিযোগ, তাদের জমিতেও জোরপূর্বক পুকুর খনন করা হচ্ছে। বাধা দিতে গেলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এখন তিনিও পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় আছেন।

অন্যদিকে, নিমাই বিলে জোরপূর্বক পুকুর খননের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে জুলাই-৩৬ পরিষদ, সবুজ সংহতি ও বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের পক্ষ থেকে গত ১৩ মার্চ স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, পুকুর খনন চক্র কৃষকের ধানি জমি নষ্ট করে পুকুর কাটছে। বাধা দিতে গেলে তারা কৃষকদেরই প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। এমনকি কৃষকদের ধানি জমিতে সেচ দেওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ করতে গেলে থানার ওসি উল্টো ফ্যাসিস্টদের সহযোগী তকমা দিয়ে ভুক্তভোগী এক নারীকেই গ্রেপ্তারের ভয় দেখান এবং মামলা নিতে আপত্তি জানান। অথচ ভুক্তভোগী সেই নারী জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের একজন সম্মুখযোদ্ধা। থানার ওসি প্রভাবশালীদের পক্ষ নেন এবং তাদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য ওই নারীকে চাপ দেন।

বাগমারায় কৃষকের জমিতে এভাবে জোরপূর্বক পুকুর খনন সরেজমিনে গিয়ে দেখে এসেছেন জুলাই-৩৬ পরিষদের আহ্বায়ক মাহমুদ জামাল কাদেরী। তিনি বলেন, আমরা আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক ফ্যাসিস্ট সরিয়েছি আরেক ফ্যাসিস্টের উত্থানের জন্য নয়। পরিবেশের ক্ষতি করে, মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং জমি দখল করে যারা সমাজে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে আমরা তাদের ছাড় দেব না। অবিলম্বে এই পুকুর খনন প্রশাসনকে বন্ধ করতে হবে।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ সম্মেনল করেছেন জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুল। শুক্রবার দুপুর নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার একটি রেস্তোরায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টুটুল বলেন, জমি দখল করে পুকুর খননের সঙ্গে আমার ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নেই। মামলা হওয়ার পরে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম তারা চারবার সেখানে অভিযান চালিয়েছে। তারা আমার নাম পায়নি। কিন্তু হঠাৎ করে মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। জিডিতেও আমার নাম নেই। যে বা যারা এসবের সাথে সম্পৃক্ত, আমিও চাই তাদের শাস্তি হোক।

বাগমারা থানার ওসি তৌহিদুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ নেওয়া হয়নি এটা ঠিক নয়। অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হলেও তাদের বিপক্ষে থানায় জিডি হয়েছে। এটা আদালতে প্রসিকিউশনের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রসিকিউশনের পর আদালতের নির্দেশনা অনুসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাগমারার ইউএনও মাহবুবুল ইসলাম বলেন, নিমাই বিলে পুকুর খনন বন্ধ করতে চারবার অভিযান চালিয়েছি। আমি এক্সকেভেটর যন্ত্র অকার্যকর করে এসেছি। আমরা খবর রাখছি। পুকুর খনন হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *