রিয়াদের লাইব্রেরিতে চার শতাধিক অমূল্য কোরআন পাণ্ডুলিপি

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে অবস্থিত কিং আবদুলআজিজ পাবলিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে পবিত্র কোরআন শরিফের চার শতাধিক বিরল ও অমূল্য পাণ্ডুলিপি। এই পাণ্ডুলিপিগুলো ইসলামি ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের ক্যালিগ্রাফি, অলংকরণ এবং আরব ও ইসলামী শিল্পকলার অসামান্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে ১০ম থেকে ১৩তম হিজরি শতাব্দীর বহু কোরআন পাণ্ডুলিপি রয়েছে, যেগুলো আরবি ও ইসলামি ক্যালিগ্রাফির নান্দনিক উৎকর্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন বহন করে।

এই সংগ্রহের মধ্যে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পাণ্ডুলিপি রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – আয়াতুল কুরসি খচিত একটি রোল, যার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যজুড়ে রয়েছে খোদাই ও অলংকরণ। পাণ্ডুলিপিটির শুরু এবং শেষে উদ্ভিদ-গুল্মের মোটিফে রঙ ও সোনার পানি ব্যবহার করা হয়েছে। ১২৮৪ হিজরিতে ফখরুদ্দিন সোহরাওয়ার্দি এটি অনুলিপি করেন।

আরেকটি মনোমুগ্ধকর পাণ্ডুলিপিতে রয়েছে মাত্র ৩০টি পৃষ্ঠা, যেখানে প্রতি দু’টি বিপরীত পৃষ্ঠা মিলে পবিত্র কোরআনের একটি পূর্ণ পারা গঠিত হয়েছে। এর প্রথম পাতায় উজ্জ্বল রঙ ও সোনার পানিতে আঁকা উদ্ভিদের মোটিফ লক্ষ্য করা যায়। ১২৪০ হিজরিতে (১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দ) নসখ্ হরফে লেখা এই পাণ্ডুলিপির প্রতিটি পৃষ্ঠা সোনায় মোড়ানো এবং পাশের ফ্রেমগুলোতে রঙিন অলংকরণ বিদ্যমান।

সংগ্রহশালায় আরও রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ কোরআনের কপি, যা ১০২৫ হিজরির (১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দ) পবিত্র রমজান মাসে মক্কা নগরীতে প্রখ্যাত আলেম মোল্লা আলি আল-কারি কর্তৃক লিখিত। কালো কালিতে লিখিত এই পাণ্ডুলিপিতে প্রতিটি আয়াতের নিচে রঙিন ছকে স্বরচিহ্নগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

অন্য একটি পাণ্ডুলিপিতে সূরা আল-ফাতিহা থেকে সূরা আন-নাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ কোরআন লিপিবদ্ধ রয়েছে, যা ৯২০ হিজরিতে (১৫১৪ খ্রিষ্টাব্দ) সোনালী অলংকরণসহ চামড়ায় বাঁধাই করা হয়। এই পাণ্ডুলিপিতে সূরাগুলোর শুরুতে ফুল ও জ্যামিতিক নকশা সোনার পাতা দিয়ে অঙ্কিত।

একটি রাজকীয় কোরআন কপি হিসেবে বিবেচিত হস্তলিখিত সংস্করণে সোনা, সবুজ, লাল ও নীল রঙের ব্যবহার দেখা যায়, যা রঙিন টেবিলে আয়াত লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জানা গেছে, এটি দীর্ঘ সময় ধরে অত্যন্ত যত্ন সহকারে লেখা হয়েছিল এবং এটি সোনালী ফুল ও নকশায় সজ্জিত চামড়ার মোমযুক্ত বাঁধাই দ্বারা সুরক্ষিত।

সংগ্রহে থাকা আরেকটি পাণ্ডুলিপি ‘মিরর’ বা ‘আয়না’ শৈলীতে লেখা, যেখানে প্রতিটি লাইনের শুরু ও শেষ অংশ নিখুঁতভাবে প্রতিসাম্য রক্ষা করে সাজানো হয়েছে। লাইনের মধ্যবর্তী অংশগুলোতে সোনার মেঘসদৃশ অলংকরণ রয়েছে।

কিং আবদুলআজিজ পাবলিক লাইব্রেরির এই বিপুল সংগ্রহে আন্দালুসিয়ান ও মরোক্কান স্কোয়ার পার্চমেন্টে লেখা প্রাচীন কোরআন, ভারতীয় পুষ্পশোভিত অলংকরণে সমৃদ্ধ কপি, এমনকি চীনা, কাশ্মিরি ও মামলুক শৈলীর পাণ্ডুলিপিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। হস্তলিপিগুলোতে কূফি, নসখ্, সুলুস, টিম্বুক্তু এবং সুদানের পরবর্তী সময়ের হস্তলিপি শৈলীর বৈচিত্র্য দেখা যায়। এছাড়া শাম, ইরাক, মিসর, ইয়েমেন, নাজদ ও হিজাজ অঞ্চলের হস্তলিপিও এতে স্থান পেয়েছে, যা ইসলামি কোরআন শিল্পের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে।

যুগে যুগে মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের শিল্পীরা কোরআন লিখনে তাদের নিজস্ব নান্দনিকতা, রঙের ব্যবহার এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেছেন, যা ইসলামি শিল্প ও ক্যালিগ্রাফির এক গৌরবময় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ জানায়, এসব অমূল্য পাণ্ডুলিপি ইসলামী সভ্যতার শিল্পবোধ ও জ্ঞানচর্চার গভীরতা ও উৎকর্ষতার স্বাক্ষর বহন করছে। গবেষক ও আগ্রহী দর্শনার্থীদের জন্য এই অনন্য সংগ্রহ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *