
খান জাহান আলী (রহ.) ছিলেন বৃহত্তর খুলনা-যশোর অঞ্চলের প্রভাবশালী শাসক ও সুফিসাধক। তিনি খ্রিস্টীয় ১৫ শতকে এই অঞ্চল শাসন করেন। তাঁর উপাধি ছিল উলুগ খান ও খান-ই-আজম। প্রথমে খান জাহান আলী (রহ.) দিল্লির তুগলক সুলতানদের অধীনে আমির (প্রশাসক) হিসেবে এই অঞ্চলে আসেন। পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের পক্ষ থেকে অত্র অঞ্চলের জায়গির লাভ করেন। তবে শাসনকাজে যে অনেকটা স্বাধীনতা ভোগ করতেন তা তার কর্মপরিধিতে অনুমান করা যায়। তাঁর শাসনাধীন অঞ্চলকে খলিফাতাবাদ বলা হতো। খলিফাতাবাদের সীমানা সুন্দর বন থেকে নড়াইলের উত্তরের নলদি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
খান জাহান আলী (রহ.)-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুর্গম সুন্দরবন অঞ্চল বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। তাঁর হাত ধরে এই অঞ্চলের বহু অবকাঠামো গড়ে উঠে। যার মধ্যে শহর, মসজিদ, মাদরাসা, সরাইখানা, সড়ক, মহাসড়ক, সেতু ও মিষ্টি পানির দিঘি অন্যতম। ষাটগম্বুজ মসজিদ তাঁর নির্মিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। তিনি তাঁর নির্মিত ইমারতে এক নতুন স্থাপত্য রীতির প্রবর্তন করেন। যা ‘খান জাহানি রীতি’ নামে পরিচিত। এসব উন্নয়নমূলক কাজে তাঁর দুই নায়েব বুরহান খান ও ফতেহ খান তাঁকে সহযোগিতা করেন।
খান জাহান আলী (রহ.) একজন প্রভাবশালী শাসক হওয়ার পরও তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট বুজুর্গ ও সুফি সাধক। শাসনকার্য, নতুন জনবসতি ও নগর স্থাপনের ব্যস্ততা তাঁকে কখনো আধ্যাত্মিক সাধনা থেকে বিমুখ করতে পারেনি, বরং নির্জনে আল্লাহপ্রেমের সাধনা করতে তিনি নির্মাণ করে নেন একটি ইবাদতগাহ, যাকে প্রাচীন যুগের খানকার সঙ্গেও তুলনা করা যায়। বর্তমানে স্থাপনাটি সাবেকডাঙ্গা নামাজঘর নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদের সঙ্গে এই নামাজঘরের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার।
নামাজঘরটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ১৯৮৫ সালে এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে তালিকাবদ্ধ হয়। একই সঙ্গে এটি চৌচালা রীতিতে স্থাপিত একমাত্র প্রাচীন নিদর্শন। নামাজঘরটি সংরক্ষণে কয়েকবার সংস্কার কাজ করা হয়েছে।
নামাজঘরের সামনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক স্থাপিত তথ্যবিবরণিতে লেখা হয়েছে, পুরাকীর্তিতে প্রবেশের একমাত্র প্রবেশ পথ দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এখানে কোনো মিহরাব বা কর্ণার টাওয়ার নেই। ফলে এই পুরাকীর্তিকে মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কথিত আছে, খান জাহান আলী (রহ.) তাঁর বিশেষ প্রার্থনার জন্য কক্ষটি নির্মাণ করেন।
সাবেকডাঙ্গা নামাজঘরের বাইরের দিকের দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণে সাত দশমিক ৮৮ মিটার এবং প্রস্থ পূর্ব-পশ্চিমে পাঁচ দশমিক ১০ মিটার করে। দেয়ালের পুরুত্ব এক দশমিক ৪৭ মিটার। প্রবেশপথ দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথ ছাড়া এখানে আর কোনো দরজা বা জানালা ছিল না। নামাজঘর তৈরিতে লাল ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এর কার্নিশগুলো অনেকটা ধনুকের মতো বাঁকা আর চৌচালা ছাদ। ভিতরের দেয়ালে পোড়ামাটির ফুল আর লতা-পাতার কারুকাজ করা। এর স্থাপত্য শৈলীতে দিল্লির তুঘলকি ও স্থানীয় বাঙালি শৈলীর সম্মিলন ঘটেছে।
খান জাহান ১৪৫৯ সালের ২৫ অক্টোবর (২৭ জিলহজ ৮৬৩ হি.) ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর নিজের তৈরী সৌধে সমাহিত হন। আল্লাহ তাঁর কবরকে শীতল করুন। আমিন।
তথ্যঋণ : বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়া